E-Paper

পালাবদলের ঝাঁকুনি

গত বছর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই হয়তো, নেপালের এই বিষম সঙ্কটময় পরিস্থিতির সামনে ভারত এখন সতর্ক। কোনও পক্ষেই মতদান করা থেকে দিল্লি বিরত থেকেছে, শান্তির আহ্বান জানিয়েছে।

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:২৮

হিমালয়সমান হিংসা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার গর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়েছে প্রতিবেশী পার্বত্য দেশ নেপাল। গত কয়েকদিন ধরে সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখছে জনতার ক্ষিপ্ত রোষ— বিপ্লব, বিদ্রোহ না অরাজক হিংসা, তাকে কী বলা হবে, সে প্রশ্ন বিতর্কযোগ্য। কেবল শাসকসমাজ নয়, সাধারণ মানুষের প্রতিও ধাবিত হয়েছে লাগামছাড়া হিংসার আক্রমণ। বাস্তবিক, নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন নয়, জন-উত্থানও অপরিচিত নয়। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার নিরিখেও ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের নেপাল সর্বার্থে অদৃষ্টপূর্ব, ঐতিহাসিক। প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি পদত্যাগে বাধ্য ও বিতাড়িত। সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিয়েছে পালাবদলের। এই মুহূর্তে দেশের প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি অন্তর্বর্তী সরকারের পছন্দসই মুখ। নেপালের রাজনৈতিক হালহদিসের সঙ্গে পরিচিত সকলেই জানেন, এই সরকারের পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তার পথটি যে এত ভয়ঙ্কর হবে, মুুহুর্মুহু অগ্নিসংযোগে— পার্লামেন্ট থেকে ব্যক্তিগত বাসস্থান, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পত্নীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, অগণিত নিরীহ মানুষকে প্রহার ও নির্যাতনের মাধ্যমে— এই পালাবদল আসবে, তা প্রত্যাশিত ছিল না। যে দ্রুততায় ক্ষোভাগ্নি ছড়িয়েছে, পুড়িয়েছে, তাতে অন্য কোনও বহিঃশক্তির প্রণোদনা এর পিছনে আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। রাজনীতির পালাবদলে এই উগ্র হিংসা অমঙ্গলের দ্যোতক। দ্রুত স্বস্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসুক, পরবর্তী সরকার শান্তির পথে স্থিত থাকুক, প্রথমে এই আশা ব্যক্ত করা জরুরি, তার পর অন্য কথা।

জেন-জ়ি’র এই অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ স্ফুলিঙ্গটি ছিল সমাজমাধ্যম সাইটগুলির উপরে সরকারের সপাট নিষেধাজ্ঞা। চেনা চিনা পদ্ধতিতে যে নেপালের সমাজ শাসন করা চলবে না, তা নিয়ে কাঠমান্ডুর চিন-ঘনিষ্ঠ শাসকবর্গ সচেতন ছিলেন না। মুহূর্তমধ্যে স্ফুলিঙ্গ থেকে তৈরি হল দাবানল, যার উপকরণ ও পরিস্থিতি আগে থেকেই মজুত ছিল অবশ্যই। চূড়ান্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য ক্রমেই লঙ্ঘনাতীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সমাজশীর্ষে সুবিধাভোগী সম্পন্ন শ্রেণির ফুলেফেঁপে ওঠার পাশে গভীর দারিদ্রখাদের দূরত্ব দ্রুত বাড়ছিল। কর্মসংস্থানের বিপুল অভাবে অধিকাংশ তরুণতরুণীকে বাড়ি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে থাকতে হচ্ছিল। তার সঙ্গে চেপে বসছিল কর্তৃত্ববাদের শিকল, যার সাক্ষাৎ প্রমাণ সমাজমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা। এই ‘প্রেশার কুকার’ পরিস্থিতিতে চাপের আতিশয্য কখন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে বুঝতে পারেননি নেপালের শাসকবর্গ। ঠিক যেমন এক বছর আগে বোঝেনি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। ঠিক যেমন ২০২২ সালে বোঝেনি শ্রীলঙ্কার মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার।

গত বছর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই হয়তো, নেপালের এই বিষম সঙ্কটময় পরিস্থিতির সামনে ভারত এখন সতর্ক। কোনও পক্ষেই মতদান করা থেকে দিল্লি বিরত থেকেছে, শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। তবে কূটনৈতিক ভাবে দিল্লির অবস্থান কত বিপন্ন, এই ঘটনাতেও তা স্পষ্ট। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ওলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েও ভারতের প্রতি বিষোদ্গার করেছেন, এবং পরবর্তী শাসকপক্ষ যে ভারতকে মোটেই সুনজরে দেখবে না, তা-ও ইতিমধ্যে স্পষ্ট। ভারত-নেপাল সীমান্ত বরাবর প্রহরা কঠোরতর করা দরকার, যদিও তাতে ভারতে কর্মরত কয়েক লক্ষ নেপালি নাগরিক যে প্রবল অসহায় হয়ে পড়বেন, তাও ঠিক। এ এক বিরাট দুর্ভাগ্য যে, বর্তমান সময়ে ভারতের চতুর্দিকে সীমান্ত-বরাবর কেবলই অশান্তি ও বিপদের মাত্রা বাড়ছে। ভারত-শাসকদের কপালে নিশ্চয় অতিরিক্ত ভাঁজ ফেলছে এই নিকট প্রতিবেশী দেশগুলির উপর্যুপরি দৃষ্টান্ত। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি এই বিপদক্ষণে শাসকদের অতি জরুরি কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন— গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানই ভারতের প্রধান রক্ষাকবচ, তাকে সুরক্ষিত রাখাই কিন্তু সবচেয়ে বড় কাজ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Nepal Bangladesh Politics Gen Z Democracy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy