কলকাতার রাস্তায় অ্যাপ-ক্যাব চালকের ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে এক চক্ষু চিকিৎসককে যে অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ মন্ত্রীর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন যে, নির্দেশিকা জারি করে চালকদের চোখ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা যায় কি না, তা প্রশাসন খতিয়ে দেখবে। গণপরিবহণ চালকদের চোখ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁর দৃষ্টিশক্তির উপরে যাত্রীদের এবং পথচারীদের সুরক্ষা বহুলাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু, গাড়ির চালকের আসনে যিনি বসেন, তিনি শুধুমাত্র চোখের সমস্যাতেই আক্রান্ত হবেন, এবং সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী হাসপাতালে বিনামূল্যে চোখ পরীক্ষা করালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, বিষয়টি এমন জলবৎ নয়। গত বছর শহরে দু’টি বাসের দুই চালক স্টিয়ারিং-এ বসা অবস্থায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই আপৎকালীন পরিস্থিতি কলকাতার মতো জনবহুল শহরে কী ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা সহজে অনুমেয়। সুতরাং, পথে চালকের সার্বিক সুস্থতা একান্ত কাম্য।
এবং বিষয়টি শুধুমাত্র গণপরিবহণেরই নয়, ব্যক্তিগত গাড়িচালকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উপরোক্ত ঘটনায় অ্যাপ-ক্যাব চালকের চোখে যে সমস্যা আছে, আরোহী চিকিৎসক তা সহজে ধরেছিলেন। কিন্তু অন্যত্র, বিশেষত ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে এমন সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। চালক মদ্যপান করেছেন কি না, রাতবিরেতে নাকা চেকিং করেই প্রশাসন সে ভাবনায় ক্ষান্ত দেয়। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লাইসেন্সধারী চালকেরও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে পারে, শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে, প্রতিবর্ত ক্রিয়াতে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ দেশে চল্লিশোর্ধ্বদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে সুস্থতার শংসাপত্র ফর্ম ১এ জমা দিতে হয়, যাতে আবেদনকারীর দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি-সহ সামগ্রিক সুস্থতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা আছে। এই লাইসেন্স কার্যকর থাকে চালকের পঞ্চাশ বছর হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর প্রতি পাঁচ বছরে লাইসেন্স নবীকরণ করাতে হয়। কিন্তু নবীকরণের সময়সীমার মধ্যে তিনি জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও বৈধ লাইসেন্সের জোরে গাড়ি চালাতে পারবেন। পথসুরক্ষার প্রশ্নে এই ফাঁকটি বিপজ্জনক।
ফাঁক আরও অজস্র। লাইসেন্স নবীকরণের সময় চিকিৎসকের শংসাপত্র আবশ্যক। কিন্তু বাস্তবে শারীরিক পরীক্ষা এড়িয়ে কাঞ্চনমূল্যে, অতি সহজেই, শংসাপত্র ক্রয় করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে না আছে প্রশাসনিক নজরদারি, না আছে কঠোর শাস্তির ভয়। তাই, নির্দেশিকা জারি করে শুধুমাত্র গণপরিবহণ চালকদের চোখ পরীক্ষার বিষয়টি কিঞ্চিৎ হাস্যকর। গাড়ির চালকের সুস্থতার সঙ্গে যখন নাগরিকের জীবন-প্রশ্নটি জড়িয়ে, তখন সর্বাগ্রে ‘দেখছি, দেখব’-র সরকারি অভ্যাসটি ঝেড়ে ফেলে— চালকের শারীরিক সুস্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে চল্লিশের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এবং পরবর্তী পর্যায়ে বছরে এক বার সুস্থতার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। গণপরিবহণের সঙ্গে যুক্ত চালকরা যাতে বিনামূল্যে সেই পরীক্ষা করাতে পারেন, প্রয়োজনে তার ব্যবস্থা করা হোক। দূষণের প্রশ্নে গাড়ির স্বাস্থ্যের যদি মাপকাঠি নির্ধারণ করা যেতে পারে, পথসুরক্ষার প্রশ্নে গাড়িচালকদের ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা করা যাবে না কেন?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)