আশঙ্কাই শেষে সত্যি হল। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র সঙ্গে দেশের সহযোগিতা কার্যকর ভাবে স্থগিত রাখতে এ বার বিল পাস করল ইরানের পার্লামেন্ট। তেহরানের দাবি, তাদের পারমাণবিক স্থানগুলির উপরে ইজ়রায়েল এবং আমেরিকার সাম্প্রতিক বিমান হামলার জেরেই এই পদক্ষেপ করতে বাধ্য হল তারা। সেই সঙ্গে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, কোনও পরিস্থিতিতেই অসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করা হবে না। তাদের অভিযোগ, আইএইএ পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার কারণেই ইরানের পারমাণবিক স্থানগুলির উপরে হামলার নিন্দা করতে অস্বীকার করে। তেহরানের এমনও দাবি, এই মাসে ইরানের বিরুদ্ধে আইএইএ-র পরমাণু অ-সম্প্রসারণের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের ঘোষণাই শেষে তাদের বিরুদ্ধে ইজ়রায়লের আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে। বস্তুত, আমেরিকার হামলার পরেই পারমাণবিক অ-সম্প্রসারণ চুক্তি (এনপিটি) ছাড়ার হুমকি দেয় তেহরান।
১৯৬৮ সালে স্বাক্ষরিত এবং ১৯৭০ সালে কার্যকর হয় এনপিটি। এই আন্তর্জাতিক চুক্তির লক্ষ্য হল পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিস্তার রোধ, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং সেই সঙ্গে নিরস্ত্রীকরণে সহযোগিতা বৃদ্ধি। চুক্তিটি রাষ্ট্রপুঞ্জের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা, আইএইএ-র তত্ত্বাবধানে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে সকল স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারকে সমর্থন করে। অন্য দিকে, চুক্তির ১১টি অনুচ্ছেদের একটিতে এটি ত্যাগ করার পদ্ধতিও উল্লিখিত আছে। এতে বলা হয়েছে, প্রতিটি পক্ষেরই চুক্তি থেকে সরে আসার অধিকার আছে, যদি এই চুক্তির কোনও কিছু তাদের দেশের স্বার্থকে গুরুতর বিপন্ন করে। লক্ষণীয়, ১৯৬৮ থেকেই এই চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় রয়েছে ইরান। আবার সেই সময় থেকেই অভিযোগ, পারমাণবিক উপাদান সংগ্রহ এবং পরমাণু সংক্রান্ত কার্যকলাপ সম্পর্কে আইএইএ-কে পূর্ণ সহযোগিতা করেনি ইরান। ভুললে চলবে না যে, পারমাণবিক পদার্থ ব্যবহার, সংরক্ষণ বা পরিচালনাকারী প্রতিটি দেশকে তাদের অবস্থা আইএইএ-কে জানানোর কথা। তবে এটাও সত্য যে, সহযোগিতা না করলেও, আমেরিকার জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের অধিকর্তা তুলসী গ্যাবার্ড গত মার্চেই দাবি করেছিলেন যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না। ফলে যুদ্ধের হেতু বোঝা মুশকিল। অথচ, বিনা উস্কানিতে চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ চালাল ইজ়রায়েল ও আমেরিকা। এই পরিস্থিতিতে তেহরানের চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসা দুর্ভাগ্যজনক, তবে অপ্রত্যাশিত বলা চলে না।
বলা বাহুল্য, চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলে এনপিটি-র প্রয়োজনীয়তা মেনে চলার বাধ্যতা থাকবে না ইরানের। সে ক্ষেত্রে আইএইএ-র সুরক্ষা ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিদর্শক এবং বাকি বিশ্ব ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকবে। ফলে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার পথ আরও সুগম হয়ে যাবে ইরানের ক্ষেত্রে। শুধু তা-ই নয়, ইরানের এ-হেন পদক্ষেপ অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো ত্যাগের নজির স্থাপন করতে পারে। ফলে, এই আক্রমণের তথাকথিত সাফল্যে ‘মোহিত’ আমেরিকা ও ইজ়রায়েলের পদক্ষেপ আগামী দিনে তাদেরই আহত করে কি না, সময়ই তা বলবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)