মাত্র বছরখানেকের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলগুলিতে প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে ভর্তির সংখ্যা কমেছে উদ্বেগজনক ভাবে। পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশনের তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ সালের তুলনায় ২০২৩-২৪ সালে প্রাক্-প্রাথমিকে এক লক্ষ পড়ুয়া কমেছে, প্রাথমিকে কমেছে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে দাবি করে আসছেন যে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এ রাজ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা শূন্য, সেখানে এই বিপুল ফাঁক তৈরি হল কী করে? শিক্ষা দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, হয়তো এই শিশুরা বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে, হয়তো বা ভর্তি হয়েছে রাজ্যের বাইরে। এমন গুরুতর একটি বিষয়ে যে নির্দিষ্ট উত্তর তাঁদের জানা নেই, নানা সম্ভাবনা কল্পনা করে কাজ চালাচ্ছেন, এ বড় ভয়ের কথা। বেসরকারি স্কুলে শিশুরা ভর্তি হলেই বা সেই তথ্য কেন থাকবে না রাজ্যের কাছে? তবে কি বেসরকারি স্কুলগুলি নথিভুক্ত নয়? ছাত্রছাত্রীরা কোথায় পড়ছে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে বাস্তবিক স্কুলছুটের চিত্রটি কিছুতেই স্পষ্ট হতে পারে না। তা ছাড়া, কেনই বা এত অল্প সময়ের মধ্যে এত অভিভাবক আস্থা হারাচ্ছেন সরকারি স্কুলে? এত দিন অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি স্কুলে নথিভুক্তি ছিল কম। সেই ছবি এত দ্রুত বদলে গেলে দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিনামূল্যে শিক্ষার পাশাপাশি মিড-ডে মিল, বই, জামা-জুতো দিচ্ছে সরকারি স্কুল। গ্রামীণ রোজগার বৃদ্ধির ইঙ্গিত যেখানে দেখা যাচ্ছে না, সেখানে সন্তানের শিক্ষা-পুষ্টির জন্য বাড়তি খরচ কেন বহন করতে চায় দু’লক্ষাধিক পরিবার, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
সুলভে উন্নত মানের বনিয়াদি শিক্ষা সামাজিক ন্যায়ের এক প্রধান স্তম্ভ— অমর্ত্য সেন-সহ নানা বিশেষজ্ঞ বার বার সে কথা বলেছেন। তার পথ দেখাতে হবে সরকারকেই। ন্যায়, নীতির কথাগুলি পরিহাসের মতো শোনায়, যখন সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষকের আকালের ভয়াবহ চিত্রটি সামনে আসে। এ রাজ্যে দু’হাজারেরও বেশি প্রাথমিক স্কুলে হয় শিক্ষক নেই, না হলে রয়েছেন মাত্র এক জন শিক্ষক। কোনও স্কুলে এক জন শিক্ষককে চার-পাঁচটি শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হলে, সে-স্কুলে বাস্তবিক পড়াশোনা হবে না বলেই মেনে নিতে হবে। সাংবাদিকদের সমীক্ষাতেও সেই সব ছবিই ধরা পড়েছে। যেমন, বীরভূমের রামপুরহাটে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী সামলাচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে, যখন স্কুলের একমাত্র শিক্ষক পড়াচ্ছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিকে। এই খুদে ‘দিদিমণি’ নিজে পাঠ-বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষক নিরুপায়, ছাত্রীও। এক শ্রেণিকক্ষে এক জন শিক্ষক একাধিক শ্রেণিকে পড়ালে শিশুরা কী করে শ্রেণি-উপযোগী পাঠ রপ্ত করবে? মনে রাখতে হবে, এ রাজ্যের শিশুশিক্ষা কেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলির দশাও। দীর্ঘ দিন নিয়োগের অভাবে স্কুলশিক্ষার এই সমান্তরাল ব্যবস্থাটি ধুঁকছে। আরামবাগ-গোঘাটের বহু শিক্ষাকেন্দ্র এখন পরিত্যক্ত, সমাজবিরোধীদের আখড়া।
কোভিড লকডাউনে স্কুলশিক্ষার যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল, তাতে শিক্ষা-ঘাটতি মেটানোর জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা দরকার ছিল। অথচ, নিয়মিত নিয়োগের অভাব, এবং শিক্ষকের ইচ্ছা-অনুসারে বদলি, এই দুই বিচ্যুতির ফলে স্কুলশিক্ষার শিকড় আরও আলগা হচ্ছে। এই শিক্ষা-বঞ্চনা প্রান্তিক, দরিদ্র এলাকায় আরও তীব্র। জঙ্গলমহলের ব্লকগুলিতে এক-শিক্ষক স্কুলের সংখ্যা বেশি, পুরুলিয়ায় তা সর্বাধিক। আড়শার নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮৪ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য মাত্র এক জন শিক্ষক বরাদ্দ, এ সংবাদে গোটা রাজ্যেরই মাথা নত হয়ে আসে। সংবিধান সংশোধন করে শিক্ষাকে প্রতিটি শিশুর ‘অধিকার’ ঘোষণা করেছে দেশ, এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি প্রাথমিক স্কুল থাকা আবশ্যক করেছে। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকে স্কুলের অধীনে এনেছে নয়া শিক্ষানীতি। এত পরিকল্পনা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে শিক্ষকের অভাবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)