অপ্রতুল, অপরিষ্কার, অসুরক্ষিত— এই হল কলকাতায় গণশৌচালয়ের চিত্র। মহিলা, ট্রান্স, কুইয়ার এবং বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের জীবনে তার প্রভাব কতখানি, তার একটা ছবি পাওয়া গেল কলকাতার একটি অসরকারি সমীক্ষায়। কেবল হাওড়া স্টেশন এবং শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে তাকালেই পরিস্থিতির কিছুটা আন্দাজ মেলে। দিনে ন’লক্ষেরও বেশি মানুষ যাতায়াত করেন হাওড়া দিয়ে, সেখানে শৌচাগারের সংখ্যা মেয়েদের জন্য উনিশ, বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য পাঁচ। শিয়ালদহে দৈনিক স্টেশন ব্যবহারকারীর সংখ্যা অন্তত ১৫ লক্ষ, মেয়েদের শৌচাগার রয়েছে চব্বিশটি, বিশেষ ভাবে সক্ষমদের মাত্র তিনটি। ভুক্তভোগীরা জানেন, জাতীয় সড়কগুলির ধারে কিছু জনসুবিধা থাকলেও, রাজ্য সড়কগুলির পাশে তা নেই। পুরুষদের শৌচাগারের সংখ্যাও তথৈবচ, কিন্তু পুরুষরা উন্মুক্ত শৌচে লজ্জাহীন, স্বচ্ছন্দ। মহিলাদের ক্ষেত্রে সঙ্কটের মাত্রা অনেকগুলি। এক, স্বাস্থ্যহানি। শৌচাগার ব্যবহার করা সম্ভব নয় জেনে মহিলা এবং ট্রান্স ও কুইয়ার মানুষেরা কম জল খান, দীর্ঘ ক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখেন, যার জন্য কিডনির অসুখে ভোগেন। আবার অপরিষ্কার শৌচাগার ব্যবহারের জন্য ভোগেন মূত্রনালির সংক্রমণে। দুই, যৌন হয়রানি এবং হিংসা। শৌচাগারগুলি যে নিরাপদ নয়, তা দেখাল এই সমীক্ষাটি। ছিটকিনির অভাবে আধ-খোলা দরজা, বাইরে পুরুষ রক্ষী। বিশেষ ভাবে বিপন্ন ট্রান্স ও কুইয়ার মানুষেরা। তাঁদের অর্ধেকেরও বেশি জানিয়েছেন, গণশৌচাগারে তাঁরা হয়রানি, হিংসায় আক্রান্ত হচ্ছেন। ৫৩ শতাংশ মহিলা এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষ গণশৌচাগারে নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করছেন, পুরসভার কাছে এ এক মস্ত ব্যর্থতা। ‘মডেল’ শৌচাগার নির্মাণ, আর ঘটা করে তার উদ্বোধনই যথেষ্ট নয়। দশটিতে ছ’টি শৌচাগারই যে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের নাগালের বাইরে, হাত ধোয়ার সাবান মেলে না, দশ জনের তিন জন ব্যবহারকারী অপরিচ্ছন্নতার অভিযোগ করেছেন। দরকার গণ-শৌচাগারের মানচিত্র নির্মাণও, যা দেখাবে বণ্টনে অসাম্য।
তবে যে মাত্রাটি সকলে এড়িয়ে যায়, তা হল শৌচাগারের অভাবে কর্মনিযুক্তি এবং রোজগারে হানি। কাজের জন্য বহু মেয়েকে, বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত মজুর, ব্যবসায়ী, বিক্রেতাদের কর্মক্ষেত্র হল শহরের রাস্তা। শৌচাগার না থাকায় তাঁরা বাধ্য হন কাজের সময় সংক্ষিপ্ত করতে, না হলে দেহের কষ্ট আর স্বাস্থ্যহানিকে কাজের শর্ত বলে মেনে নিতে। ৭২ শতাংশ মেয়ে টাকা দিয়ে শৌচাগার ব্যবহার করেন। ব্যয় হয়ে যায় দৈনিক রোজগারের অন্তত ১০ শতাংশ। এর পরেও রয়েছে জরিমানা— গাড়ি বা মালপত্র রেখে শৌচাগার গেলে পুলিশের কোপ, স্টেশনে ঢুকলে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাবি। সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা ক্যাফে কিংবা শপিং মল-এর বাথরুম ব্যবহার করতে পারেন, শ্রমজীবী মেয়েদের সে সুযোগ নেই। পরিকাঠামোর এই অভাব যে কেবল অবহেলা বা কার্পণ্যের প্রতিফলন, তা-ই নয়, এর মধ্যে নিহিত এই মনোভাব যে, ঘরের বাইরের পরিসর মেয়েদের জন্য নয়।সেখানে তাঁদের দীর্ঘ সময় কাজ করার কথাই নয়, যাঁরা তা করেন, লজ্জিত, যন্ত্রণাবিদ্ধ হতে হবে তাঁদেরকেই। সরকারি দফতরে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা শৌচাগারে যাঁরা তালা ঝোলান, লজ্জা তাঁদের নয়।
ভারতে মেয়েদের কর্মনিযুক্তি কেন বাড়ছে না, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়। মেয়েদের নিয়োগ বাড়লে দেশের জিডিপি কত বাড়ত, তার চর্চাও চলে। কিন্তু শৌচাগার বা ক্রেশ-এর মতো মৌলিক পরিকাঠামো নির্মাণ না করলে যে মেয়েদের কাজে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়, সরকার সে সত্যটা দেখেও দেখছে না। কেবল শৌচাগারের অভাবে কত মেয়ে দক্ষতা, প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও রোজগারে ঘাটতি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে, তার ইঙ্গিত দিচ্ছে এই সমীক্ষা। শৌচাগারের অভাবের অর্থ, বৈষম্য এবং অনুন্নয়ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)