E-Paper

ষষ্ঠ রিপুর বশে

সংসারের লাগানি-ভাঙানি থেকে মহৎ ব্যক্তিদের উপর আক্রমণ, শুভ উদ্যোগের বিরোধিতা, এই সব কিছুর পিছনে কাজ করে ‘মূল্যহীন, হৃদয়হীন’ সমালোচনা।

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৪১
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

যে মানুষরা সাহায্য করেছেন বা এখনও করছেন তাঁদের কাছ থেকে কোনও বিরূপ সমালোচনা বা নিন্দা নেই, যাঁরা কিছুই করেন না এবং শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথ খোঁজেন, তাঁরাই কেবল নিন্দা ও সমালোচনা করেন। এ রকম মূল্যহীন, হৃদয়হীন, স্বার্থযুক্ত ও নোংরা সমালোচনার চেয়ে বড় আশীর্বাদ আমার কাছে নেই।” কথাগুলি নিউ ইয়র্ক থেকে লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, ১৮৯৯ সালে। এক ইংরেজ বন্ধুর চিঠিতে জেনেছিলেন তাঁর সম্পর্কে রটতে থাকা অপবাদ— স্বামীজি বিলাস-ব্যসনের জীবন কাটাচ্ছেন, পাশ্চাত্যের লোকেরা তার টাকা জোগাচ্ছে। উত্তর আছড়ে পড়েছে চাবুকের মতো— “তোমাদের মধ্যে এ কথা বলবার দুঃসাহস কার আছে যে, তোমাদের কাছে খাবার পানীয়, সিগার, পোশাক বা টাকা চেয়েছি?” তাঁর কাজের জন্য যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিটি পাইপয়সা কাজের জন্যই রাখা রয়েছে, নিজের ভাইকেও শূন্য হাতে দেশে ফিরিয়েছেন, বলছেন বিবেকানন্দ। চিঠির সমাপ্তি অবশ্য হয়েছে মধুর আশ্বাসে— “ভারতের একজন নগণ্য সন্তান হিসাবে আমি তোমাকে ভালবাসি ভারতীয় প্রেমে...।” তবু ছত্রিশ বছরের এক যুবকের এই চিঠিতে বোঝা যায়, এক বিশালহৃদয়, স্বার্থশূন্য সন্ন্যাসীও ঈর্ষান্বিত, ক্ষুদ্রহৃদয় মানুষদের কটূক্তিতে কতখানি আহত হয়েছিলেন। অকারণ ঈর্ষা, অহেতুক বৈর— এ সব যেন সংসারের দহনজ্বালার অন্যতম। কখনও বা মনে হয়, ‘ভাল করতে নেই, মন্দ করতে আছে’— এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। যতই পরিণতবুদ্ধি, স্থিরমস্তিষ্কের মানুষ হন না কেন, মিথ্যা অপবাদ, অকারণ শত্রুতা তাঁদের আহত, বিপর্যস্ত করেছে। ক্ষত আরও গভীর হয় যখন তা আসে নিকটজনের থেকে। যাঁরা নিজেদের হিতৈষী বলে দাবি করেন, তাঁরাই আড়ালে নিন্দা ছড়াচ্ছেন, এ কথা জানলে কে না বেদনার্ত হন? বিদ্যাসাগর নিজের সম্পর্কে কারও কুমন্তব্য শুনে নাকি বলেছিলেন, তিনি তো সেই লোকটির কোনও উপকার করেননি, তা হলে সে নিন্দা করছে কেন? এই একটি উক্তি যেন বিদ্যাসাগরের আহত হৃদয়টি খুলে দেখিয়ে দেয়।

সংসারের লাগানি-ভাঙানি থেকে মহৎ ব্যক্তিদের উপর আক্রমণ, শুভ উদ্যোগের বিরোধিতা, এই সব কিছুর পিছনে কাজ করে ‘মূল্যহীন, হৃদয়হীন’ সমালোচনা। তার আঘাতের যন্ত্রণাই ব্যক্ত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও, নোবেলপ্রাপ্তির পর শান্তিনিকেতনে নাগরিক সংবর্ধনার উত্তরে তিনি বলেন, “দেশের বহু লোকেরই আমার প্রতি যথার্থ কোনও ভালবাসা নেই, সেটা আমি জানি। আজ একটা আকস্মিক আনন্দের জোয়ারে অনেকে ভেসে চলেছেন, কিন্তু এ স্রোত চলে গেলেই আবার ধাপে ধাপে পাঁক বেরিয়ে পড়বে।” শাস্ত্রমতে এই ‘পাঁক’ হল মাৎসর্য— ষড়রিপুর একটি। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আর মদের মতো, মাৎসর্যও একটি ‘রিপু’ বা শত্রু। এ হল পরশ্রীকাতরতা— অন্যের ‘শ্রী’ দেখতে না পারা। অন্যের সম্পদ, সৌন্দর্য, সাফল্য দেখে এতই কাতরতা জাগে, যে মাৎসর্যগ্রস্ত মানুষটি নিজের সম্পদ ভোগ করতে পারে না, স্বজনের দিকে তাকিয়ে কোনও সুখ অনুভব করে না। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ দেখে হস্তিনাপুরে ফিরে বিমর্ষ দুর্যোধন শকুনিকে বলছেন, “আমি অগ্নিপ্রবেশ করব, বিষ খাব, জলে ডুবব, জীবনধারণ করতে পারব না।” পুত্রকে শোকগ্রস্ত দেখে উদ্বিগ্ন ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্ন করলে দুর্যোধন উত্তর দেন, “পাণ্ডুপুত্রদের সমৃদ্ধি দেখে আমি মনে মনে দগ্ধ হচ্ছি, আমার শান্তি নেই।” কেন এই অকারণ জ্ঞাতিবিদ্বেষ, পিতার সেই প্রশ্নের উত্তরে দুর্যোধন বলেন, যিনি সন্তাপের কারণ তিনিই শত্রু।

কুরুক্ষেত্রের বিশাল বিনষ্টির মূলে ছিল দুর্যোধনের মাৎসর্য— নিজের ঐশ্বর্যে সন্তুষ্টি নয়, নিজের বাহুবলে রাজ্যজয়, সম্পদ আহরণও নয়, তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল পাণ্ডবদের নিঃস্ব করা। অন্যকে অপদস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত, বিব্রত করে নিজের চিত্তে সুখ অনুভবের এই তাগিদ কাজ করে বহু মানুষের অন্তরে। অন্যের সাফল্যে, সুখবরে মুখে আনন্দ প্রকাশ করলেও অন্তরে বিদ্ধ হন না, এমন মানুষ কি বিরল নন? এই বেদনা, কাতরতা থেকে জাগে ঈর্ষা, অমঙ্গল কামনা। নিজের চিন্তা, বাক্য ও চেষ্টা অপরের ক্ষতির জন্য ব্যয় করতে বাধ্য করে। অকারণ বাধা, মিথ্যা অপবাদ এ ভাবেই জন্ম নেয়। যদিও সকলেই অনুভব করেন যে, অপরের ক্ষতি হোক আর না হোক, মাৎসর্যের দংশনে নিজের অন্তরে রক্তক্ষরণ হতেই থাকে। অন্যের আনন্দে যাঁরা আনন্দিত হতে পারেন, তাঁরা সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। তাঁদের প্রাপ্তি রিপুমুক্তির আনন্দ, যা অন্তরের নিরন্তর সাধনার ফল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

opinion

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy