এই অগস্ট মাস জুড়ে ভারতে যা চলছে, তাকে বলা যেতে পারে দেশের গণতন্ত্র রক্ষার কার্যক্রম। জাতীয় নির্বাচন কমিশন বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া বা এসআইআর শুরু করার পর থেকেই দেশ জুড়ে এক গভীর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। সেই প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে আপাতত বিরোধী রাজনীতি ও ভারতের বিচারবিভাগ দুই তরফেই চেষ্টা চলছে যাতে নির্বাচন কমিশনের কর্মপদ্ধতি দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রটি ধ্বস্ত না করতে পারে, যাতে ভোটার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার কাজটিতে বিপুল পরিমাণে নাগরিক অধিকার ভঙ্গ ও দলিত না হয়। একটি প্রাথমিক প্রশ্ন— নির্বাচন কমিশনই কি ভোটার বা নাগরিক হিসাবে মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়ার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান? তবে কেন্দ্রীয় সরকারের সবুজ সঙ্কেতে নির্বাচন কমিশন বিহার রাজ্যে এসআইআর চালিয়ে ইতিমধ্যেই ৬৫ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পর ওই প্রশ্ন ছাড়িয়ে সঙ্কট চলে গিয়েছে পরবর্তী স্তরে। বিশেষত রাহুল গান্ধী ৭ অগস্ট বিস্তারিত ভাবে ভোটার তালিকা সংশোধনের ত্রুটিবিচ্যুতি ব্যাখ্যা করার পর, এবং ১২ অগস্ট যোগেন্দ্র যাদব প্রমুখ সর্বোচ্চ আদালতে কমিশন-কর্তৃক মৃত হিসাবে ঘোষিত বাতিল ভোটারদের ‘সশরীর’ উপস্থাপিত করার পর, সমগ্র ঘটনা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। ইতিমধ্যেই বিহারে বাতিল নামের প্রতিটির ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর বিরোধী দাবি নির্বাচন কমিশন পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে বুঝতে অসুবিধা নেই, ১৪ অগস্টে নির্বাচন কমিশনের প্রতি সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশ এল— সব বাতিল ভোটারের বাতিল হওয়ার হেতু দ্রুত জানানোর নির্দেশ— তা এক বিপুল গুরুত্ব বহন করে। হেতুবিহীন ভাবে কারও নাম তালিকা থেকে বাদ গেলে তা হবে দেশের এত দিনের গণতান্ত্রিক সাধনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এ দিকে বাদ যাওয়ার প্রক্রিয়া যে প্রবল বেগে চলমান, বিহারই তার প্রমাণ। ভারতের মতো জনবহুল দেশে এত তাড়া দিয়ে এই কাজ করার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না, অথচ বিহারের ভোটের আগেই বিহারে, এবং পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন ভোটের আগেই পশ্চিমবঙ্গে যে অত্যধিক দ্রুততার সঙ্গে এত গুরুতর প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণ ভিন্ন এর অন্যতর ব্যাখ্যা অসম্ভব। নির্বাচন কমিশন ও সেই সূত্রে কেন্দ্রীয় শাসককে মনে রাখতে হবে, বিষয়টি ছেলেখেলা নয়, গণতন্ত্রকে শাসকের দলতন্ত্রে পরিণত করা যায় না। ভোটার পরিচিতির প্রশ্ন আক্ষরিক অর্থে দেশবাসীর জীবনমরণের প্রশ্ন। বিরোধী রাজনীতিকরা সে প্রশ্ন তুলছেন বলে এই মুহূর্তে প্রশ্নকারীদেরই অপরাধী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে।
এসআইআর নিয়ে বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়া নামের ক্ষেত্রে সিংহভাগই নারী— ২৫ লক্ষ পুরুষের পাশে বাদ গিয়েছেন ৩২ লক্ষ নারী। বিবাহ ও স্থানান্তরণের কারণে, এবং পরিবারগত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, ভারতীয় মেয়েদের ক্ষেত্রে যে পরিচিতিপত্র প্রদানের বিশেষ কতকগুলি সমস্যা থাকে, তা সর্বজ্ঞাত। তবু সময় বা সুযোগ না দিয়ে সরাসরি তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হল, ভোটের অর্ধেক আকাশ ফাঁকা করে দেওয়ার চরম অমানবিকতা ও পশ্চাদ্গামিতা প্রদর্শিত হল। মৃত ভোটারদের নাম তালিকায় থাকা, আর মৃত বলে জীবিত ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, কোনটি বেশি অন্যায়, সেই প্রশ্নও ওঠে বইকি। তা ছাড়া যে ১১টি নথির উপর কমিশন এত দিন জোর দিচ্ছিল, তাতে আধার ও ভোটার কার্ড ছিল অস্বীকৃত— অথচ এখন সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে আধার কার্ডের ভিত্তিতে বাতিল ভোটার আদালতে আপিল করতে পারেন। এর তাৎপর্য সুদূর, জটিলতাও বহুদূরগামী। এই জটিল আবর্তের সঙ্গে যুঝে, দারিদ্র-অশিক্ষা অধ্যুষিত দেশে কত জন বাতিল ভোটার আদৌ আদালত অবধি দৌড়িয়ে নিজেদের নাম তালিকায় আবার ফেরত আনতে উদ্যোগী হতে পারবেন? অর্থাৎ, মূল প্রশ্নটি— নির্বাচন কমিশনের কাজের প্রক্রিয়াগত ও লক্ষ্যগত সাংবিধানিকতা নিয়েই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)