E-Paper

নাম ও দুর্নাম

মেট্রো-স্টেশনের নাম ছেলেখেলার জায়গা নয়, গুণিজনদের আবেগী শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের হাজারো উপায় আছে। বিমানবন্দর স্টেশনের নাম ‘জয় হিন্দ’ রাখলে কি মেট্রোযাত্রীদের দেশপ্রেম ডানা মেলে আকাশে উড়বে?

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৩৩

নীল, সবুজ, কমলা, হলুদ, বেগুনি— পাঁচটি রঙের নামে কলকাতা মেট্রো রেলের পাঁচটি পথ এই মুহূর্তে শহরে সক্রিয়। যদিও সব ক’টিতেই এই মুহূর্তে পুরো রুট চালু নেই, তবু সদ্য উন্মুক্ত বা পরিবর্ধিত অন্তত তিনটি লাইনে বিপুল যাত্রীর ভিড় বুঝিয়ে দিচ্ছে, সাধারণ নাগরিকদের কাছে মেট্রো পরিষেবার যখন যেটুকু মেলে তা-ই বড় পাওয়া। দিনের ব্যস্ততম সময়ে হাওড়া ময়দান থেকে অল্প সময়ে ও খরচে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে সল্ট লেক অঞ্চলে, ব্লু লাইনে নোয়াপাড়া পৌঁছে সংযুক্ত ইয়েলো লাইন ধরে চলে যাওয়া যাচ্ছে বিমানবন্দর এলাকায়, দক্ষিণ শহরতলির কবি সুভাষ থেকে অরেঞ্জ লাইন ই এম বাইপাস বরাবর এগিয়ে দিচ্ছে বেশ কিছুটা পথ— কলকাতার মতো এমন জনভারপীড়িত নগরের কাছে এই সুবিধার বিকল্প নেই।

আর ঠিক সেই কারণেই প্রয়োজন শহর জুড়ে বিছিয়ে থাকা মেট্রো স্টেশনগুলির সহজ, কার্যকর নামকরণ। মেট্রো রেলের সার্বিক মানচিত্রটি যদি কোনও সাধারণ মেট্রোযাত্রীর চোখের সামনে মেলে ধরা হয়, কোন স্টেশন কোন এলাকার সংলগ্ন তা কি তিনি স্টেশনের নাম দেখে অনায়াসে বলতে পারবেন? মেট্রো কর্তৃপক্ষ যাচাই করে দেখতে পারেন— উত্তরটি এখনও পর্যন্ত ‘না’। পুরনো ব্লু লাইনেই হোক বা সদ্য-সম্প্রসারিত অরেঞ্জ লাইন, বেশ কিছু স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে বাঙালি মনীষী, দেশনেতা, বিপ্লবী, বিশিষ্ট লেখক শিল্পী প্রমুখের নামে। মনীষীরা মাথায় থাকুন, কিন্তু এ-ই কি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ নমুনা? মেট্রো স্টেশনের নাম তার সংলগ্ন এলাকা বা নিকটতম পুরনো স্থান-নির্দেশক কোনও কিছুর নামেই হওয়া দরকার, একমাত্র তা হলেই যাত্রীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবেন। বিশেষ করে নতুন রুটের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনটি অতি জরুরি ও নির্বিকল্প: ভিআইপি বাজার বা যশোর রোড স্টেশন-নাম যেমন তার কাছাকাছি এলাকাগুলিকে নির্দেশ করছে, তেমনটাই প্রতিটি ক্ষেত্রে হওয়া উচিত। এখনকার বেলেঘাটা মেট্রো স্টেশন যেখানে, মূল বেলেঘাটা অঞ্চল সেখান থেকে বহু দূরে— এই নামকরণ কি সে ক্ষেত্রে ঠিক কাজ হল? এ তো আসলে যাত্রীদের ‘বিপথ’-এ চালিত করা! কবি সুকান্ত বা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী স্টেশন থেকে যাত্রীরা সংলগ্ন এলাকার বিন্দুমাত্র পরিচয় পাবেন না, সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হবেন। মেট্রো-স্টেশনের নাম ছেলেখেলার জায়গা নয়, গুণিজনদের আবেগী শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের হাজারো উপায় আছে। বিমানবন্দর স্টেশনের নাম ‘জয় হিন্দ’ রাখলে কি মেট্রোযাত্রীদের দেশপ্রেম ডানা মেলে আকাশে উড়বে?

এমন কাজ আগেও হয়েছে। ব্লু লাইনে টালিগঞ্জ-গড়িয়া অংশে মাস্টারদা সূর্য সেন, শহিদ ক্ষুদিরাম বা গীতাঞ্জলি স্টেশন-নামগুলিই প্রমাণ। তা নিয়ে কম কথা হয়নি— কোন জমানায় কে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন থরথর বাঙালি আবেগে এই নামকরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে আবার কোন মন্ত্রীর নির্দেশে স্টেশনের বোর্ডে ও মেট্রোর ঘোষণায় সংলগ্ন এলাকাগুলির নাম লিখে ও বলে দেওয়ার রীতি চালু হয়েছে, এই সবই কলকাতাবাসী জানেন। নেতা-মন্ত্রীরা মেট্রোয় চড়েন না, চড়েন সাধারণ মানুষ, ভুগতেও হয় তাঁদেরই। এই ভোগান্তি তাঁরা মেনে নেন ভবিতব্য হিসাবে, যাবতীয় অসুবিধা সহ্য করেন হাসিঠাট্টায়— মেট্রোর টিকিট কাউন্টারে ‘দুটো নেতাজি’ বা ‘চারটে মহানায়ক উত্তমকুমার দিন’ নিয়ে সমাজমাধ্যমে মিম তৈরি হয়। আসলে কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছেন নাগরিকেরা সব মেনে নেবেন, স্টেশনের নামকরণে তাঁদের মত-অমত বিবেচনার কোনও প্রশ্নই নেই। এ এক বৃহত্তর অবহেলার ক্ষুদ্র নমুনামাত্র। এ দেশে বা রাজ্যে প্রশাসন তার ক্ষমতা স্টিমরোলার যদৃচ্ছ চালাবে, যা খুশি সিদ্ধান্ত নিয়ে নাগরিকের উপরে চাপিয়ে দেবে। নাগরিকও তা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবেন, এবং এ ভাবেই তৈরি হবে সরকারি অবহেলা ও নাগরিক নির্লিপ্তির এক বিরাট ‘সংস্কৃতি’। নতুন দৌড়নো মেট্রোও এর ব্যতিক্রম হতে পারল না, নামকরণের পুরনো অসুখ তাকেও ধরল, এটাই দুঃখের।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kolkata Metro Metro Railways

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy