পরিবেশ-বান্ধব, অধিক উৎপাদনশীল এবং লাভজনক কৃষির পথ কী, এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটেও তার কোনও দিশা পাওয়া গেল না। বরং, ২০২০ সালের কৃষক আন্দোলনের ‘খেসারত’ আজও দিতে হচ্ছে দেশকে— কৃষিতে বরাদ্দের কার্পণ্যের ধারা এখনও অব্যাহত। চলতি অর্থবর্ষের সংশোধিত বাজেটের চাইতে তিন শতাংশ কম টাকা বরাদ্দ হয়েছে আগামী অর্থবর্ষের জন্য। যে সব খাতে টাকা কমেছে, তার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (২৩ শতাংশ হ্রাস), কারণ পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্য কেন্দ্রের প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের প্রকল্প চালু করেছে। এ ছাড়া অপর যে দু’টি খাতে কৃষি বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয়, সেগুলি হল পিএম-কিসান প্রকল্প (চাষিদের বছরে ছ’হাজার টাকা অনুদান) এবং কৃষি ঋণে ভর্তুকি (চার শতাংশ থেকে সাত শতাংশ সুদে স্বল্পমেয়াদি ঋণ)। দু’টি প্রকল্পেই বরাদ্দ যথাপূর্বম্, বৃদ্ধির অঙ্ক শূন্য— মূল্যবৃদ্ধি ধরলে যার অর্থ, বরাদ্দ কমছে। ইউরিয়া-সহ অন্যান্য সারে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দও তথৈবচ। এমনকি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নতুন যে প্রকল্পটি ঘোষণা করলেন বাজেট-বক্তৃতায়, সেই ‘প্রধানমন্ত্রী ধনধান্য কৃষি যোজনা’-র জন্যও আলাদা কোনও বরাদ্দ হয়নি। কৃষিতে প্রচলিত নানা প্রকল্পের সমন্বয় করেই দেশের একশোটি কম উৎপাদনশীল জেলাকে উচ্চ উৎপাদনশীল করার চেষ্টা হবে। কৃষক আন্দোলনের মুখপাত্ররা হতাশ— তাঁদের যেগুলি প্রধান দাবি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ক্রয়ের ব্যবস্থাকে আইনি স্বীকৃতি দান, আরও বেশি ফসলের সরকারি ক্রয়, এবং কৃষিঋণ মকুব, তার কোনওটিই পূরণ হয়নি।
কিন্তু খুচরো অপ্রাপ্তির চাইতেও বেশি মনোযোগ দাবি করে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের প্রতি সরকারের অনীহা। দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের জিডিপি-তে কৃষির অবদান কমছে, বর্তমানে তা ১৭ শতাংশের মতো। অথচ ভারতের মানুষের কৃষি-নির্ভরতা কমছে না। বরং তা কিছুটা বেড়েছে— ২০১৮-১৯ সালে ৪২ শতাংশ থেকে ২০২৪-২৫ সালে ৪৬ শতাংশ। বাড়তি মজুর কৃষিক্ষেত্রে আসার ফলে খেতমজুরদের বাস্তবিক মজুরি কমেছে। এঁরা ভারতের দারিদ্রসীমার নীচের মানুষদের এক বৃহৎ অংশ। এক দিকে অকৃষি ক্ষেত্রে কাজ তৈরির ব্যর্থতা, অন্য দিকে কৃষিকে অধিক উৎপাদনশীল, অধিক লাভজনক করার ব্যর্থতার জন্য ভারতে দারিদ্র গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অবসানের জন্য সার্বিক সংস্কারের প্রয়োজন, শিল্প-পরিষেবায় কাজ বাড়াতে হবে, কায়িক শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়িয়ে সে-সব কাজের উপযুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে লাভজনক করতে হবে কৃষিকেও— উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, বিপণনের আধুনিক কৌশল প্রয়োগ করে, ফসল প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থাকে বহু গুণ বিস্তৃত করে। বার্ষিক আর্থিক সমীক্ষাগুলি তেমন সুপারিশই বার বার করছে। কিন্তু বাজেটে যৎসামান্য বরাদ্দ (মোট বাজেটের সাড়ে তিন শতাংশের মতো) বুঝিয়ে দেয়, সংস্কারকে চালনা করার মতো শক্তি বা সদিচ্ছা নরেন্দ্র মোদী সরকারের নেই।
অতএব কৃষি বাজেটের ভাল-মন্দের আলোচনা কিছু প্রকল্পের ভাল-মন্দের বিচারেই আটকে থাকতে চায়। ডাল উৎপাদনে ভারতকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে চাষিদের থেকে হাজার কোটি টাকার ডাল কিনবে সরকার, সেটা ভাল কথা। উচ্চ-উৎপাদনশীল, কীট-প্রতিরোধক বীজ তৈরিতে একশো কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, সে-ও বেশ। আনাজ-ফল উৎপাদকদের আয় বাড়ানোর জন্য প্রকল্প দেখলে আশা জাগে, কিন্তু বরাদ্দের অঙ্ক দেখে মুষড়ে পড়তে হয়। ফল-আনাজের ৩৭ শতাংশ নষ্ট হয়, যার মূল্য দেড়শো লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। সংরক্ষণ-প্রক্রিয়াকরণের পরিকাঠামো তৈরির জন্য বিপুল বিনিয়োগ চাই। সরকার দিচ্ছে পাঁচশো কোটি টাকা, যা দিল্লিতে নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ খরচের থেকেও কম। কৃষি গবেষণা, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র একুশ কোটি টাকা। নতুন প্রযুক্তি ও তার প্রসারের কাজ তবে ফের মুলতুবি রইল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)