পশ্চিমবঙ্গে মেয়েরা কতটা নিরাপদ, সে প্রশ্ন এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। এক দিকে জাতীয় স্তরের সমীক্ষা, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রতিবেদন (২০২৩) দেখাচ্ছে যে কলকাতা সব চাইতে নিরাপদ শহর, মেয়েদের উপর অপরাধের হারের নিরিখেও কলকাতার অবস্থান ভাল— চেন্নাই এবং কোয়মবত্তূরের পরেই। এই ‘উজ্জ্বল’ পরিসংখ্যান যেন বিদ্রুপ করছে বছরভর সংবাদ-শিরোনামে মেয়েদের প্রতি জঘন্য নানা অপরাধের ধারাবিবরণীকে। সম্প্রতি দুর্গাপুরে কলেজ-ক্যাম্পাসের সন্নিকটে এক মেডিক্যাল ছাত্রীর ধর্ষণ-নির্যাতনের অভিযোগ ফের গোটা রাজ্যকে বিপর্যস্ত করেছে, যেমন করেছিল গত বছর আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে এক পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যা। এই দুইয়ের মধ্যে ঘটে গিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার একটি আইন কলেজে নিরাপত্তা রক্ষীর ঘরে এক ছাত্রীর ধর্ষণ-সহ একাধিক হাড় হিম করা ঘটনা। এই অবিশ্রাম হিংসাস্রোত জনমানসে গভীর আঘাত করেছে, প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ সবের ফলে এ রাজ্যে নারীহিংসার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাকে খুঁটিয়ে দেখার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ধর্ষণের প্রতিরোধে পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা, তদন্ত ও বিচারের পরিকাঠামোয় গলদ, সর্বোপরি অভিযুক্তের প্রতি শাসক দলের প্রশ্রয়ের যে সব অভিযোগ গত এক বছরে বার বার ধ্বনিত হয়েছে, রাজ্য সরকারকে সেগুলি অস্বস্তিতে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে এনসিআরবি-র পরিসংখ্যানকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ‘সাফল্যের শংসাপত্র’ হিসেবে দেখাতে চাইছে তৃণমূল। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিবেদনে কলকাতা পর পর চার বার ‘সব চাইতে নিরাপদ শহর’ সাব্যস্ত হয়েছে, অতএব আইন-শৃঙ্খলায় এ রাজ্য শ্রেষ্ঠ। নারীহিংসা প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদ ও সমালোচনা কেবলই বিরোধীদের অসার নিন্দা— এমন একটা প্রচার চলেছে।
এই প্রবণতা বিপজ্জনক। কারণ, এমন মনগড়া ‘সাফল্য’ সামনে রেখে নারীহিংসার মতো গুরুতর সমস্যাকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা অতীতেও লক্ষ করা গিয়েছে রাজ্য সরকারের মধ্যে। তাই ধর্ষণের বিচার চেয়ে জনসমাজ উত্তাল হলেও, তদন্ত ও বিচারের পরিকাঠামোয় সংস্কারের কোনও চেষ্টাই নেই। ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করার প্রক্রিয়া স্বচ্ছন্দ করার জন্য ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ খুঁড়িয়ে চলছে। ফরেন্সিক তদন্ত-ব্যবস্থার দশা তথৈবচ। মেয়েদের জন্য হেল্পলাইন চালু হয়নি। উপরন্তু মুখ্যমন্ত্রী বার বার আক্রান্ত মেয়েদের উপরেই নানা সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করছেন, তাঁদের গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ চাইছেন। অথচ, ধর্ষণে অভিযুক্তদের তৃণমূল-ঘনিষ্ঠতা সামনে এলে তিনি নীরব থাকছেন। ধর্ষণের প্রতিবাদে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের হয়রান করছে তাঁর সরকার। অন্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা টেনে এই ‘ধর্ষণ-সংস্কৃতি’র গ্লানি মোচন করা যায় না।
জাতীয় মহিলা কমিশনের সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালে নারীহিংসার চার লক্ষ মামলা বিচারাধীন ছিল পশ্চিমবঙ্গে, যা দেশে সর্বাধিক। এনসিআরবি-র রিপোর্টে নগর-নিরাপত্তায় ‘ফার্স্ট বয়’ হয়ে বুক বাজাতে চাইলে নারীহিংসার মামলায় যথাসময়ে চার্জশিট জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘লাস্ট বয়’ হওয়ার লজ্জাও স্বীকার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এনসিআরবি কেন্দ্রীয় সংস্থা হলেও সমীক্ষার তথ্য জোগায় রাজ্য। গোড়ার তথ্যেই যদি জল মেশানো থাকে— যদি পুলিশ আক্রান্ত মেয়েদের এফআইআর দায়ের করা থেকে নিরস্ত করে, যদি বড় অপরাধেও লঘু ধারা আরোপ করে, তা হলে সত্যের একটা আবছা প্রতিকৃতিই কেবল পাওয়া যেতে পারে সমীক্ষায়। উপরন্তু, নারীহিংসার অভিযোগের সংখ্যা কমলেই তাকে সুশাসনের প্রমাণ বলে ধরা চলে না। কারণ, থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করার জন্যেও মেয়েদের সামাজিক সক্ষমতা প্রয়োজন হয়। জাতীয় মহিলা কমিশনের পর্যবেক্ষণ, তিনজন মেয়ের দু’জনই যৌন হয়রানির অভিযোগ দায়ের করে না। আইনশৃঙ্খলা, তথা নারী-নিরাপত্তার পরিমাপ তো একটিমাত্র নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)