আরও এক বার প্রত্যাখ্যাত হল উমর খালিদ ও তাঁর সঙ্গীদের জামিনের আবেদন। গত পাঁচ বছরে এই নিয়ে ছয় বার। এর অর্থটি সোজাসরল, রাষ্ট্রের হাতে তাঁদের আটক তথা বন্দি থাকার সময়টি দীর্ঘায়িত হল, ক্যালেন্ডারে পাঁচটি বছর পেরিয়েও। মনে রাখতে হবে, এই বন্দিদশা সম্পূর্ণত বিচারহীন অবস্থায়— বিচারপ্রক্রিয়ার কিছুই এই অর্ধদশকে শুরু হয়নি, অদূর ভবিষ্যতেও তার নামগন্ধ দেখা যাচ্ছে না, সরকারপক্ষ নাকি এই মামলার আট-ন’শো সাক্ষ্য এখনও যাচাই করে চলেছে। অন্য দিকে, জামিনের আবেদন নাকচ করে দিল্লি হাই কোর্টের মন্তব্য, যে মামলার চার্জশিট তিন হাজার পাতারও বেশি, বৈদ্যুতিন সাক্ষ্যপ্রমাণও বিপুল, তার গতি ‘স্বাভাবিক ভাবে’ই চলবে; বিচারপ্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো করলে দু’পক্ষেরই ক্ষতি। ফলত, উমরদের বন্দিদশা চলবে।
জামিনই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কারাবাসই ব্যতিক্রম— মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি উমর খালিদদের বারংবার জামিন প্রত্যাখ্যানের আবহে এক জন সাধারণ ভারতীয় নাগরিক কোন চোখে দেখবেন? সুপ্রিম কোর্ট এক দিকে অভিযুক্তের জামিনের পক্ষে কথা বলছে, অন্য দিকে ইউএপিএ-তে অভিযুক্তের ক্ষেত্রে ভারতের নানা ট্রায়াল কোর্ট ও হাই কোর্টগুলি কোনও রকম ‘ঝুঁকি’ না নেওয়ায় অভিযুক্তের বিচারহীন, জামিনহীন বন্দিদশা বেড়েই চলেছে— এ হেন হেরফের কি নাগরিকদের বিভ্রান্ত, শঙ্কিত করবে না? সাম্প্রতিক কালে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজন সুপ্রিম কোর্টে জামিন পেয়েছেন, গত বছর অগস্টে শীর্ষ আদালত বিশেষ ভাবে এ-ও বলেছে যে, ইউএপিএ-তে মামলা হলেও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নে অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করা উচিত। উমর ও তাঁর সঙ্গীরা কেন এই মুহূর্তেই জামিন পাওয়ার যোগ্য, বিচারহীন অবস্থায় কারাগারে তাঁদের অর্ধদশক কাটিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সে উত্তরটি নিহিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনও নাগরিককে এ ভাবে বিনা বিচারে রুদ্ধ করে রাখা চলে না, তা তাঁর ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’র লঙ্ঘন, সর্বোপরি ভারতের সংবিধানের প্রাণভোমরা ‘আর্টিকল ১৯’-এ বর্ণিত নাগরিকের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
এই সব কথাই অগণিত বার বলা হয়েছে— মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার ও আইনের আলোচনায়, এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও। তবু কার্যক্ষেত্রে যে কিছুই হয় না, উমর খালিদদের একের পর এক জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েই চলে, বেড়ে চলে বিচারহীন বন্দিদশাও— এ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। আরও হতাশাজনক: ঠিক কী কারণে এই জামিনের আবেদন নাকচ করা হচ্ছে, আদালতের তরফে তার স্পষ্ট ও বোধগম্য ব্যাখ্যার অভাব, এমনকি তার চেষ্টাটুকুরও অভাব। সরকারপক্ষ উমরদের বিরুদ্ধে প্রমাণস্বরূপ যা যা পেশ করেছে, সেগুলির গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতাই শুধু আদালতের বিচার্য হওয়া উচিত, সরকারপক্ষের বয়ানে থাকা ফাঁক কি আদালত নিজ উদ্যোগে পূরণ করতে পারে? ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গার প্রেক্ষিতে জনসভায় উমর খালিদের ‘ইনকিলাবি সালাম’-এর মতো শব্দবন্ধ আদালতের মতে অপরাধমূলক, কারণ যত ক্ষণ না স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হচ্ছে যে এই ‘ইনকিলাব’ রক্তপাতহীন, তত ক্ষণ তার মানে দাঁড়ায়, এ আসলে হিংসার ইন্ধন। অথচ, ওই একই বক্তৃতায় বক্তার একাধিক বার শান্তিপূর্ণ, অহিংস প্রতিবাদের আহ্বানও ছিল, যে বিষয়টি পাত্তা পায়নি। উমর খালিদ ও শারজিল ইমামকে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘সামগ্রিক ষড়যন্ত্রের বৌদ্ধিক স্থপতি’ (ইন্টেলেকচুয়াল আর্কিটেক্টস), কিন্তু কাকে বলে বৌদ্ধিক স্থপতি, আইনের চোখে তার সংজ্ঞা কী, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। উমর খালিদরা তো কারারুদ্ধ, যে বিপুল নাগরিকেরা বাইরে, তাঁরাও কি তা হলে রাষ্ট্রের চোখে যে কোনও সময় ষড়যন্ত্রের বৌদ্ধিক স্থপতি হিসাবে কারারুদ্ধ হতে পারেন? তার পর সেই একই চক্রটি ঘুরবে— জামিনহীন, বিচারহীন?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)