E-Paper

অপচয়চক্র

২০১৮ সালে রাজ্য ঘোষণা করেছিল যে ফল ও আনাজ রফতানির জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং হাউস তৈরি হবে বারাসতে। আজ অবধি তা কেবল পরিকল্পনাই থেকে গিয়েছে।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:২২

জীবিকার উন্নতির জন্য সরকারি পরিকাঠামো নির্মিত হয়েও পড়ে থাকবে, কাজে লাগবে না, এই যেন রাজ্যবাসীর বিধিলিপি। সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত মিনাখাঁর বামনপুকুরের মৎস্য সংরক্ষণ কেন্দ্র, চার-পাঁচ বছরেও যা চালু হয়নি। ন’কোটি টাকা খরচে নির্মিত কেন্দ্রটি নষ্ট হচ্ছে, চুরি যাচ্ছে নানা সরঞ্জাম। ফলে বসিরহাট মহকুমার মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হাড়োয়া, বসিরহাটের মৎস্যচাষিদের অবস্থা যথা পূর্বং— তাঁরা বাড়তি খরচ করে বেসরকারি মৎস্য সংরক্ষণ কেন্দ্রে রফতানিযোগ্য মাছ, চিংড়ি মজুত করে রাখছেন। এতে করদাতার টাকার অপচয় হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে বাণিজ্যেরও। উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীদের যত বাজার ধরতে পারার কথা ছিল, তত ধরা যাচ্ছে না। এমন ছবি সর্বত্র। পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় পানিপারুল গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৫ কোটি টাকা দিয়ে লঙ্কা মান্ডি তৈরি হয়েছে দু’বছর আগে, এখনও অবধি তা চালু হয়নি। সংরক্ষণের ব্যবস্থার অভাবে কম দরে স্থানীয় ফড়ের কাছে চাষিরা লঙ্কা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ২০১৮ সালে রাজ্য ঘোষণা করেছিল যে ফল ও আনাজ রফতানির জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং হাউস তৈরি হবে বারাসতে। আজ অবধি তা কেবল পরিকল্পনাই থেকে গিয়েছে। উপরন্তু, বাম আমলে বারাসতের নীলগঞ্জ এলাকায় তৈরি একটি প্যাকেজিং হাউস কয়েক বছর চলার পর পড়ে রয়েছে— বিশাল ভবন, বড় বড় ‘কুলিং’ যন্ত্র নষ্ট হচ্ছে। এমনই ‘ভূতের বাড়ি’ হয়ে রয়েছে ফুলিয়ার হ্যান্ডলুম রফতানি করার কেন্দ্রটি। ২০০৬ সালে নির্মিত একাধিক ভবনের এই কমপ্লেক্সটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তৃণমূল আমলেও দফায় দফায় টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ অবধি সেটি তাঁতিদের কাজে লাগেনি। সর্বোপরি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার প্রতিটি জেলায় যে কৃষক বাজারগুলি তৈরি করেছিল, সেগুলির অধিকাংশই সরকারি ধান ক্রয়ের কেন্দ্র হয়েই রয়ে গিয়েছে। চাষি সরাসরি ফসল বিক্রয় করে অধিক লাভ করবে, এই আশা ধূলিসাৎ হয়েছে।

মৎস্য, কৃষি, হস্তশিল্প প্রভৃতি জীবিকাকে লাভজনক করা দারিদ্র দূরীকরণ এবং রাজ্যের উন্নয়নের প্রধান উপায়। তার জন্য চাই পণ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের যথাযথ পরিকাঠামো। দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের ঘোষণা এবং নির্মাণের বরাত দেওয়াতে যতটা আগ্রহ, সেই কেন্দ্রগুলিকে সক্রিয় করা, ফলপ্রসূ করার বিষয়ে যেন ততটাই উদ্যোগের অভাব। অথচ, শুধু বাড়ি নির্মাণ বা যন্ত্রপাতি নয়, আইনি জটিলতার ফাঁস ছাড়ানোর কাজটিও ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে বাজার ধরার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ রাজ্য ফল ও আনাজের উৎপাদনে শীর্ষের দিকে থাকলেও, ভারত থেকে যত আনাজ ও ফল রফতানি হয় তার মাত্র ২০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গের। রফতানির মোট মূল্যের মাত্র ১১ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গের। যার অর্থ, বিদেশের বাজার ধরতে পারছেন না রাজ্যের ব্যবসায়ীরা, ফলে ফসলের যথেষ্ট দামও পাচ্ছেন না চাষিরা।

এর অন্যতম কারণ আইন এবং নীতির জটিলতা— বিদেশে রফতানির শর্ত নিয়ে কেন্দ্র, রাজ্য এবং রাজ্যের ব্যবসায়ী, উৎপাদকদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব। রফতানির শর্তগুলি মেটাতে হলে বিভিন্ন দফতরকে নানা ধরনের মূল্যায়ন করে ছাড়পত্র দিতে হয়। সেগুলি পাওয়া যাচ্ছে না— কখনও কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের অভাবে, কখনও সুস্পষ্ট নীতির অভাবে। কখনও বা আলোচনাই হচ্ছে, কাজ হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে কৃষি বিপণনের যে দুর্বলতার দিকগুলি বার বার নানা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে হিমঘর এবং হিমায়িত পরিবহণের অভাব, ফসল প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার অভাব। যার ফলে বিপুল পরিমাণ ফসল নষ্ট হয়, কিংবা বিক্রি হয় অত্যন্ত কম দরে। চাষির ক্ষতি হচ্ছে, প্রাকৃতিক সম্পদও নষ্ট হচ্ছে। একই ধরনের সঙ্কট অন্যান্য উৎপাদন ক্ষেত্রেও। সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনের উপযুক্ত পরিকাঠামো কার্যকর না হলে অপচয় চলতেই থাকবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

agriculture Preservation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy