ফাইল চিত্র।
মানুষ কী পারে, আর কী পারে না, তাহার পরীক্ষা লইতেই যেন প্রকৃতি পাঠাইয়া দেয় এক-একটি দুর্যোগকে। ইয়াসের মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি লইবার সময় পাইয়াছিল রাজ্য। এই সুযোগ করিয়া দিয়াছেন বিজ্ঞানীরা। আবহাওয়া বিজ্ঞান এখন এমনই উন্নত হইয়াছে যে, বহু পূর্বেই ঝড়ের বিশদ পূর্বাভাস মিলিয়াছিল। সেই কারণেই সতর্কতামূলক প্রচার করা সম্ভব হইয়াছে; শহর ও গ্রামে বিপদ মোকাবিলার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা গিয়াছে। নদী ও সমুদ্রোপকূলের ১১ লক্ষ বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনিবার ব্যবস্থা করিয়াছিল প্রশাসন; দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এড়াইতে উড়ান, রেল, জলযান সকলই থামাইয়া দিয়াছিল; বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বিকল্প ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হইয়াছিল। পূর্বে এমন সতর্ক না হইলে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় প্রচুর প্রাণহানি হইতে পারিত। সেই মর্মান্তিক পরিণতি রাজ্য অনেকটাই এড়াইতে পারিয়াছে, তাহা কিছুটা স্বস্তির কারণ।
উল্লেখ্য, বহু ক্ষেত্রেই বলা সত্ত্বেও বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাইতে রাজি হন নাই। দুর্যোগের পর তাঁহাদের বিপত্তি সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হইয়াছে। তবে ইহাও স্বীকার করা প্রয়োজন যে, সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও চারটি জেলার নাগরিক, বিশেষত পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল এবং সুন্দরবনের দ্বীপগুলির মানুষেরা, ভয়ানক ক্ষতি ও দুর্গতির মধ্যে পড়িয়াছেন। বাড়ি ভাসিয়াছে, খেত ডুবিয়াছে, নিরাশ্রয়, নিঃসম্বল গ্রামবাসী গাছে উঠিয়া রাত কাটাইয়াছেন। কোনও কোনও সরকারি ত্রাণশিবিরেও খাবার, জল কিছুই নাই। প্রাণভয়ে ভীত, ক্ষুধাতৃষ্ণায় পীড়িত মানুষ প্রাণের ঝুঁকি লইয়া সাঁতার কাটিয়া পানীয় জলের সন্ধানে চলিতেছেন— বিপন্নতার এই চিত্রটি এই বারও সম্পূর্ণ মুছিল না। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলিয়াছেন যে, ব্যবস্থাপনার আরও উন্নতি সম্ভব ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে স্মরণে রাখা জরুরি যে, ঝড়ের পূর্বাভাস থাকিলেও যে মাত্রায় জলোচ্ছ্বাস ঘটিয়াছে, তাহা অংশত অপ্রত্যাশিত ছিল। রাজ্য জুড়িয়া যে বিপত্তি ঘটিয়াছে, তাহা মুখ্যত এই জলোচ্ছ্বাসের কারণেই। এই অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লওয়া প্রয়োজন যে, পূর্বাভাস যাহাই থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট বিপদগুলির সম্ভাব্যতার কথাও মাথায় রাখিতে হইবে। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলের নিয়মিত চরিত্রলক্ষণ, ক্রমশ তাহার সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়িয়া চলিবে, ইহাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। ফলে, অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ।
বিপর্যয়ের সঙ্কেত পাইয়াও যাঁহারা সম্পত্তি রক্ষা করিতে, বা অপর কোনও তাগিদে ঘরে থাকিয়া যাইতে চাহেন, তাঁহাদের বুঝাইয়া নিরাপদ আশ্রয়ে সরাইবার উপায় কী হইতে পারে, সহানুভূতির সহিত তাহা ভাবিবার প্রয়োজন আছে। সুন্দরবনের গ্রামগুলি সহজেই জলমগ্ন হইয়া পড়ে। সেই অঞ্চলে এক দিকে যেমন পাকাপাকি আপৎকালীন ব্যবস্থা— যেমন নিরাপদ আশ্রয়, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাব্যবস্থা— ইত্যাদির আয়োজন করিতে হইবে, তেমনই কিছু কিছু দ্বীপ হইতে পাকাপাকি ভাবে জনবসতি সরাইয়া লওয়া যায় কি না সেই বিষয়েও চিন্তাভাবনা জরুরি। নদীবাঁধের মেরামতি সংক্রান্ত বিষয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছেন। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করিয়া এই বিপদ ঠেকানো অসম্ভব। সেই আলোচনা অন্যত্র। কিন্তু স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়, মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগটি ন্যায্য হইলেও দায় শেষ অবধি তাঁহারই। পূর্বে যিনি বা যাঁহারা সেচমন্ত্রী ছিলেন, তাঁহারা— অথবা, অন্য কোনও ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক— যদি দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করিয়া থাকেন, সরকারের প্রধান হিসাবে সেই দায়ও মুখ্যমন্ত্রীর উপরই বর্তায়। অতীতের ভুল তিনি অবিলম্বে সংশোধন করিয়া লইবেন, ইহাই প্রত্যাশা। এবং ইহাই দুর্যোগ মোকাবিলার একমাত্র পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy