E-Paper

সংস্কারের গুরুত্ব

ভারতের সংবিধান সমস্ত ধর্মের মানুষকে তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের রীতি-নীতি পালনের পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সংবিধান ভারতের সমস্ত নাগরিককে যে মৌলিক অধিকারগুলি দিয়েছে, তার অন্যতম সাম্যের অধিকার। তাকে লঙ্ঘন করতে পারে না কোনও ধর্মীয় বিধি।

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৪:৪৫

মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত ‘তালাক-ই-হাসান’ বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়া সংবিধানের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কি না, সে প্রশ্ন তুলল সুপ্রিম কোর্ট। তিন বিচারপতিরএকটি বেঞ্চ জানিয়েছে, প্রচলিত ধর্মীয় রীতি খারিজ করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু তা সংবিধানের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা বিচার করা দরকার। তাই বিষয়টি পাঠানো হতে পারে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের কাছে। এক সঙ্গে তিন বার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে বিচ্ছেদের বিধি (তালাক-ই-বিদ্দাত) ২০১৭ সালেই অসাংবিধানিক এবং বেআইনি বলে ঘোষণা করেছিল সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির একটি বেঞ্চ। এ বারে একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির একটি বেঞ্চ জানিয়েছে, স্ত্রীর উদ্দেশে মাসে এক বার করে পর পর তিন মাস ‘তালাক’ বলে বিবাহবিচ্ছেদের বিধিও (তালাক-ই-হাসান) কোনও আধুনিক সমাজে চলতে পারে না। তা নারী মর্যাদার পরিপন্থী। বিচ্ছেদকামী স্বামী তাঁর আইনজীবী, বা অপর কোনও তৃতীয় পক্ষের হাত দিয়ে স্ত্রীর কাছে বিচ্ছেদের ‘নোটিস’ পাঠিয়ে দিয়ে তা বিচ্ছেদ বলে গণ্য করছেন। অথচ, এই মামলার অন্যতম আবেদনকারিণী আদালতে জানিয়েছেন, বিচ্ছেদের ওই নথি বৈধ প্রমাণপত্র বলে গণ্য না হওয়ায় তিনি পাসপোর্ট করাতে পারছেন না, সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। সুপ্রিম কোর্ট যথার্থই বলেছে যে, এই ধরনের অন্যায় কেবল আবেদনকারিণীদের প্রতি হয়েছে, এমন নয়, অগণিত মুসলিম মহিলা এই বিচ্ছেদ-রীতির জন্য অপমানিত, বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই তালাক-ই-হাসান বিধির সাংবিধানিক বৈধতা বিবেচনা করা দরকার।

এই সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন চলে না। ভারতের সংবিধান সমস্ত ধর্মের মানুষকে তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের রীতি-নীতি পালনের পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সংবিধান ভারতের সমস্ত নাগরিককে যে মৌলিক অধিকারগুলি দিয়েছে, তার অন্যতম সাম্যের অধিকার। তাকে লঙ্ঘন করতে পারে না কোনও ধর্মীয় বিধি। কোনও রীতি যদি হয় বৈষম্যমূলক, যদি তা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মর্যাদাকে লঙ্ঘন করে, তা হলে কেবল প্রাচীনতা বা পরম্পরার দোহাই দিয়ে তাকে মান্য করা চলে না। যদি কোনও বিচার-বিধি কেবল পরিচিতির ভিত্তিতে এক পক্ষের কথাকে অপর পক্ষের কথার চাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়, তবে তার সংস্কার প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, তা সহজে হয় না। আইনে সংস্কার করে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে চাইলে প্রভাবশালীরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হন। হিন্দু, খ্রিস্টান-সহ সব ধর্মে বিবাহ, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে আইনের সংস্কার নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়েই হয়েছে। ভারতের মুসলিম সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়। সংবিধান ভারতের সব মেয়েকে যে অধিকার দিয়েছে, মুসলিম মেয়েদের তা থেকে বঞ্চিত করা চলে না, এ কথা মুসলিম মেয়েদের আন্দোলন দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছে। আক্ষেপ, পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সাম্যের সেই দাবি বার বার উপেক্ষিত হয়েছে।

অথচ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান-সহ নানা ইসলাম-অনুসারী দেশে ধর্মীয় আইনের সংস্কার হয়েছে। আদালতের সামনে দু’পক্ষের উপস্থিতি, বিচ্ছেদের কারণ দর্শানো, নিজের নিজের সমস্যা ও দাবি জানানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বিচ্ছেদ আইনসম্মত করতে হলে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া, বৈধ নথিপত্র পাওয়া, এ সবই অপরিহার্য। ভারতে সমস্যা হল, পারিবারিক আইনের সংস্কারের প্রশ্ন উঠলেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গটি আসে। গত কয়েক দশকের দলীয় রাজনীতির পাকচক্রে যা অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিতর্ক এড়াতে গিয়ে মূল প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। তা হল, ভারতের মুসলিম মেয়েদের অধিকার ও মর্যাদার সুরক্ষা। শেষ অবধি বিবাহবিচ্ছেদের সংস্কারের জন্য যে বিধিই গৃহীত হোক, তাকে জোর করে চাপানো চলবে না। আনতে হবে আলোচনা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Law Constitution Democracy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy