উত্তরপ্রদেশে এক নাবালিকা হিন্দু মেয়েকে অপহরণ ও জোর করে বিয়ে করার অপরাধে অভিযুক্ত একটি মুসলিম ছেলে। অভিযুক্ত জানিয়েছে, তাদের বিয়ে হয়েছে আর্য সমাজ মন্দিরে, হিন্দু বিবাহ আইন মতে যে বিয়ে স্বীকৃত। এই মামলার সূত্রেই ইলাহাবাদ হাই কোর্ট গত সপ্তাহে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, আর্য সমাজ পরিচালিত সংস্থাগুলি তাদের কাছে আসা ছেলে বা মেয়ের বিবাহযোগ্যতার বয়স খতিয়ে না দেখে, উপরন্তু রাজ্যের ধর্মান্তরণ-বিরোধী আইন লঙ্ঘন করে কী করে দুই ধর্মের দু’টি ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে, তা অনুসন্ধান করতে।
আইন, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস— প্রতিটি বিষয়ই এই সূত্রে বিবেচনার। হিন্দু বিবাহ আইনে আর্য সমাজ পরিচালিত বিয়ে স্বীকৃত এ কথা ঠিক, ১৯৩৭-এ ‘আর্য ম্যারেজ ভ্যালিডেশন অ্যাক্ট’ও পাশ হয়। বস্তুত, ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত, দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষের কিংবা একই ধর্মের দু’টি ভিন্ন জাতি-বর্ণের মানুষের বিয়ের ‘সমস্যা’ সমাধানে আর্য সমাজের বড় ভূমিকা ছিল। তবে এও মনে রাখার, তার কেন্দ্রে ছিল ‘শুদ্ধি’ প্রথায় ভিন্ন জাতি-বর্ণ-ধর্মের মানুষের বৈদিক হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরণ; এই ধর্মান্তরণ মেনে নিজেদের ‘আর্য সমাজি’ ঘোষণা করলে ভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের বিবাহে এই প্রতিষ্ঠান না করে না। সাম্প্রতিক কালে উত্তরপ্রদেশ-সহ নানা রাজ্যে ভিন্ন জাতি-বর্ণ-ধর্মের যুগলেরা আর্য সমাজকে বেছে নিচ্ছে কারণ সেখানে ঝঞ্ঝাট কম, বিয়ের শংসাপত্র মেলে দ্রুত। তা বলে এরা সত্যিই বিবাহযোগ্য আইনি বয়সের কি না, কেউ নাবালক-নাবালিকা কি না, সেই গোড়ার কাজটি নিশ্চিত না করা দণ্ডনীয় অপরাধ— আর্য সমাজ তা না করে থাকলে আইন লঙ্ঘনের দোষ তাদের উপরে অবশ্যই বর্তায়। ভারতে বিয়ে নথিভুক্ত করার সরকারি নিয়ম (ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন রুল) আছে, আর্য সমাজের শংসাপত্র সেখানে যথেষ্ট নয়।
বিয়ে ও আইন এই দু’টি বিষয় যাতে সর্বদা পরস্পরকে মেনে চলে, ইলাহাবাদ হাই কোর্টের নির্দেশে তা স্পষ্ট। তার পরেও একটি জরুরি কথা থেকে যায়। উত্তরপ্রদেশ-সহ নানা বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন পাশ হওয়ার পর থেকেই দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিয়েতে রাজ্য সরকার ও পুলিশ-প্রশাসন প্রবল বাধা দিচ্ছে। ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’-এ যার যার ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ না করে দুই ভিন ধর্মী মানুষের বিয়ের সুযোগ থাকলেও বিয়ের ত্রিশ দিন আগে ‘পাবলিক নোটিস’ দিয়ে সেই সিদ্ধান্ত জানানো বাধ্যতামূলক। দেখা যাচ্ছে, জানাজানি হতেই ভিন ধর্মী যুগলের উপর হুমকি, হেনস্থা, অত্যাচারের খাঁড়া নেমে এসেছে, সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে বহু। শুধু পরিবার নয়, পুলিশ-প্রশাসনও এ ক্ষেত্রে নিপীড়ক, ধর্মীয় রাজনীতির কারবারি নেতা ও উগ্র সমর্থককুলের কথা না-ই বা বলা গেল। রাজ্যগুলির নিজস্ব ধর্মান্তরণ বিরোধী আইনই এ ক্ষেত্রে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট-এর পথের কাঁটা; নাগরিকের ধর্মচর্যা ও বিবাহের সাংবিধানিক অধিকার এই রাজ্যগুলিতে প্রশাসনের হাতেই, আইনি পথেই নির্লজ্জ ভাবে লঙ্ঘিত। অথচ উল্লিখিত মামলাটিতে বলা হয়েছে এই ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন মেনে চলার কথাই। প্রশাসন ও আইন যখন বিরূপ, সাধারণ মানুষের আশ্বাসস্থল তখন বিচারব্যবস্থা। নাগরিকেরা এ ক্ষেত্রে সেই আশ্বাস পেলেন কি না, প্রশ্নটি তর্কাতীত নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)