E-Paper

নিরাপত্তাহীন

মেয়েরা রাতে রাস্তায় বেরোবেন না থেকে মেয়েরা আদৌ কখনও রাস্তায় বেরোবেন না, এই তালিবানি অবস্থানের দূরত্ব বিপজ্জনক রকম কম।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:৩৫

আরও একটি ধর্ষণকাণ্ড। আরও এক বার মুখ্যমন্ত্রীর অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য। দু’টিতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠা কি তবে রাজ্যবাসীর ভবিতব্য? দুর্গাপুরে যা ঘটেছে, তা কঠোর ভাবে নিন্দনীয়। এবং, এই ঘটনার দায় নিতে হবে রাজ্য প্রশাসনকেই। দুর্গাপুরের মতো এলাকায় সন্ধে সাড়ে আটটা-ন’টার সময় কয়েক জন দুষ্কৃতী এক তরুণীকে গণধর্ষণ করতে পারে তখনই, যখন অঞ্চলটি সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়। দুষ্কৃতীরা বিলক্ষণ জানে, রাজ্য পুলিশের এমনই হাল যে, টহলদারিরও আশঙ্কা নেই, ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত পুলিশ আসবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পাশাপাশি এমন আশ্বাসও সম্ভবত রয়েছে যে, মাথার উপরে ঠিকঠাক হাত থাকলে শেষ অবধি কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না। সেই কারণেই অপরাধীরা বেপরোয়া হয়েছে। কথাটি শুধু দুর্গাপুরের জন্য সত্য নয়, গোটা রাজ্যের জন্য সত্য। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ-প্রশাসনের এই ব্যর্থতার কথা এক বারও উল্লেখ করেননি। যে কোনও অপরাধকে আড়াল করা, প্রশ্রয় দেওয়ার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার কথা বলেননি— সেই সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্তের পিছনে নিজের ভূমিকার কথাও নয়। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর স্বধর্মে স্থিত থেকে এ ক্ষেত্রেও ‘ভিক্টিম শেমিং’ করেছেন— সরাসরি না হলেও ঘটনার দায়টি চাপিয়ে দিয়েছেন নিগৃহীতার উপরে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, রাত হয়ে যাওয়ার পরও নিগৃহীতা মেয়েটি বাইরে ছিলেন কেন?

পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড থেকে বর্তমান ঘটনা, এবং অন্তর্বর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া আরও অগণিত নিগ্রহের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর এমন অসংবেদনশীল বক্তব্য প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর জি কর-কাণ্ডের পরেও সরকারি সমাধানসূত্র ছিল, মেয়েদের নাইট ডিউটি বন্ধ করে দেওয়া। মুখ্যমন্ত্রীর বোঝা প্রয়োজন যে, মেয়েদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা নয়, প্রশাসনের কর্তব্য দুষ্কৃতীদমন। এ ক্ষেত্রে আরও একটি কথা স্পষ্ট করা প্রয়োজন: দুর্গাপুরের ঘটনায় নিগৃহীতা এক জন ডাক্তারি পড়ুয়া, ফলে অনুমান করা চলে যে, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁর ক্ষেত্রে ‘বাচ্চা মেয়ে’ জাতীয় বিশেষণ প্রয়োগ করলে নাগরিক হিসাবে তাঁর গুরুত্ব খর্ব করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী সে কাজ সচেতন ভাবে করতে চেয়েছেন কি না, তা অপ্রাসঙ্গিক— কিন্তু নাগরিককে ‘ইনফ্যান্টিলাইজ়’ করা, অর্থাৎ ‘শিশু’ হিসাবে দেখানোর এই প্রবণতাটি রাজনীতিকদের মধ্যে প্রবল। নিগৃহীতা ছাত্রীকে পূর্ণ নাগরিকের সম্মান দিয়ে বুঝতে হবে যে, শিক্ষাক্ষেত্রের কাছাকাছি এলাকায় নিরাপদে রাস্তায় ঘোরা তাঁর অনস্বীকার্য নাগরিক অধিকার। ঠিক যেমন রাতে চাকরি করা, অথবা কোনও আনন্দ-অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াও লিঙ্গ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিত করা প্রশাসনের কর্তব্য। তাতে ব্যর্থ হলে সেই দায় প্রশাসনের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে। কে কখন রাস্তায় বেরোবে, আর কে ঘরে থাকবে, সেটা ঠিক করে দেওয়া তাঁর অধিকার নয়। বস্তুত, মেয়েরা রাতে রাস্তায় বেরোবেন না থেকে মেয়েরা আদৌ কখনও রাস্তায় বেরোবেন না, এই তালিবানি অবস্থানের দূরত্ব বিপজ্জনক রকম কম।

তবে, এ ক্ষেত্রে একটি অন্য দায়িত্বের কথাও গুরুত্বপূর্ণ— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। কোনও আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অপরিহার্য শর্ত, ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করা। আদর্শ পরিস্থিতিতে তার জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন হত না— পুলিশ-প্রশাসনই সেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত। কিন্তু, পরিস্থিতি যখন আদর্শ নয়, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তরফে আরও অনেক বেশি সতকর্তা জরুরি। হস্টেলের দরজা কখন বন্ধ হবে, তার পরও কোনও ছাত্র কোনও বিশেষ কারণে বাইরে থাকলে তাঁর নিরাপত্তার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, শিক্ষাক্ষেত্রের পরিসরেই বা নিরাপত্তার ব্যবস্থা কী— এই সব নিয়ে ভাবা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। মেয়েদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে নয়, তাদের স্বাধীন জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Safety Security

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy