Advertisement
E-Paper

‘জামাই’! এ শব্দকে আর তোল্লাই দেবেন না প্লিজ

আমাদের যাপনে প্রবাদবাক্যের মতো একটি কথা আছে। জোর যার মুলুক তার। এই জোর, পুরুষের।

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০০:০০

আহ্! জামাইষষ্ঠী! আজই সেই আহ্লাদের দিন (পুং)। বাংলা ক্যালেন্ডারে দু’টি তারিখে লাল-লাল, গোল-গোল দাগ দিয়ে লেখা থাকে, বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গেই— জামাইষষ্ঠী ও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। যে সমাজে পুরুষকে জন্মদাগের মতো পরিয়ে রাখা হয়েছে এই সব উৎকর্ষ, যা তাকে প্রতিনিয়ত একটি মেয়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর প্রাণী ভাবতে শেখায়, শেখায় নারীদের হেয়জ্ঞান করতে, ভোগ্যপণ্য ভাবতে, সেখানে প্রায় প্রতি দিন রাশি রাশি নারী-নিগ্রহ, বধূহত্যা, ধর্ষণ... শাস্তি আর পায় কোথায়! হয়তো একটু বুদবুদ কাটার মতো, পচা-জলে শোরগোল উঠেই থেমে যায় সে সব।

আমাদের পথচলতি যাপনে, আপ্ত কিংবা প্রবাদবাক্যের মতো একটি কথা আছে। জোর যার মুলুক তার। এই জোর, পুরুষের। তার চিন্তনে, তার শৌর্যে-বীর্যে পুষ্টি জোগায় আমাদের সমাজ ও পরিবার। অর্থাৎ, নিজের বাড়ি (ছেলেদের তো ‘বাপের বাড়ি’ নেই) এবং একই সঙ্গে শ্বশুরবাড়িও। তাকে ছোটবেলা থেকেই সবচেয়ে ভাল খাইয়ে, পরিয়ে, স্বাধীনতা দিয়ে, যত্নে মুড়ে বড় করা হয়। এবং বড় হওয়ার পর, শ্বশুরবাড়িতে সে পায় ‘জামাই আদর’! তার মধ্যে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে সেই প্রকরণ, যাতে সে একটি মেয়ের তুলনায় নিজেকে শ্রেষ্ঠতর ভাবতে শেখে। এই জোরের কারণেই সে সোনার আংটি। সংসারের সর্বময় কর্তা। সে, কলঙ্কের ধার ধারে না। সে, ভিড় জনপথে, গাড়িতে মেয়েদের বুকে খোঁচা মারতে পারে। দু’পায়ের মাঝখানে, ঠেসে, দর্পে-ওঠা অঙ্গটি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ভিক্টিম মেয়েটি গুনগুন করে প্রতিবাদিনী হলে, পুরুষকুল তেড়ে বলতে পারে, ‘অত যদি ছুঁই ছুঁই বাতিক তো ট্যাক্সি নিলেই হয়!’ সে, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। চোখ দিয়ে চেটে নেয় মর্নিং স্কুল আর কলেজে যাতায়াত করা ছাত্রীদের, ও একটু বেলায় অফিস-যাওয়া মেয়েদের শরীরের ক্লিভেজ ও খাঁজগুলি। চটচটে মন্তব্য করে, যাতে মেয়েরা কুঁকড়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যায়।

এই যে সারা ক্ষণ ছেলে তথা স্বামী তথা জামাইকে ঠাকুর ঠাকুর জ্ঞান করা... না, এখনকার মেয়েরা হয়তো ঘুম থেকে উঠে স্বামীর পাদোদক পান করবে না। কিন্তু মেধাবিনী স্ত্রী, স্বামীর কর্মস্থলে যাত্রামুহূর্তে জুতো-মোজা পরিয়ে দিচ্ছে, এ দৃশ্য এ যুগেও বিরল নয়। যেমন একটি অতি পরিচিত দৃশ্য, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাতসকালে অফিস ছুটছে, স্ত্রী হয়তো কাজের জায়গায় স্বামীর চেয়ে ওজনে অনেক ভারী শ্রমদান করছে, কিন্তু ফেরার পর গা এলিয়ে দিয়ে, বাড়ির শ্রেষ্ঠ প্রাণী, অর্থাৎ, পুরুষ যখন টিভি কিংবা বইয়ের পাতায় চোখ ডোবাচ্ছে, মহিলা তখন রান্নাঘরমুখী। চা, রাতের রান্নার জোগাড়, বাচ্চাকে সঙ্গ দেওয়াও আছে, এরই সঙ্গে। সর্বোপরি আছে, ‘আমি চাকরি করি বলে, সংসারধর্ম ঠিকমত পালন করতে পারছি না’— এই অপরাধবোধ ভোগ করা। এই পাপবোধে ভুগতে কিন্তু বাধ্য করছে সমাজ ও পরিবারের নীরব কিংবা সরব লাল-চোখ।

একটা প্রশ্ন করি, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এসে, কিংবা জামাই শ্বশুরবাড়ি এসেছে এমত অবস্থায়, সেই জামাইয়ের ‘হাত-পুড়িয়ে-বানানো’ চা ক’জন খেয়েছেন শুনি? সাম্যবিহীন আমাদের সমাজ, পরিবার ও তার আচারবিচার। সেখানে সকাল থেকে কনেবিদায়ের করুণ সুর বাজে সানাইতে। সালংকারা কনে প্রায় বলির পাঁঠার মতো অঝোরে কাঁদে। একটু পরেই ছেড়ে যেতে হবে তার বাড়ি, বাবা-মা, পড়ার টেবিল, তাকে রাখা হারমোনিয়ম। তার প্রতিবেশ তাকে শোনাচ্ছে, ‘আজ থেকে শ্বশুরবাড়িই তো নিজের বাড়ি।’ পর দিন সকালে, একদম অজানা মানুষজনের মধ্যে, অচেনা মশারির ঘেরাটোপে জেগে উঠতে হবে ওকে। দেখতে হবে সমালোচনার চোখ। নিন্দেমন্দর ঠোঁট। নববর বেজায় উৎফুল্ল। নতুন জামাইয়ের পায়ে ধুলোটি লাগতে দিচ্ছে না মেয়েবাড়ির লোকজন। বউ নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে, সঙ্গে অ্যাডেড ভ্যালু হিসেবে যৌতুক ও আর যা কিছু...

সাম্যবিহীন সেই পরিবারটিও। দিনান্তে, রোজ যেখানে, বাড়ি, বাড়ি কাজ সেরে ফিরে যায় এক তরুণী। বানানো কথা নয়, একদম জ্বলন্ত সত্যি, ছুঁলে ছ্যাঁকা খাবে আঙুল। মেয়েটিকে গর্ভবতী অবস্থায় জলকাদা পার হয়ে একটার পর একটা ইটে ব্যালান্স রেখে পেতলের ভারী কলসিতে জল নিয়ে আসতে হত রোজ। পড়ে গেলে, অনেক অঘটন ঘটে যেতে পারত। মেয়েটি শুধু এক দিনের জন্য নির্বিকার স্বামীকে জল এনে দিতে বলায় চেঁচিয়ে কলোনি মাথায় তুলেছিল শাশুড়ি। ‘স্বামী জল এনে দেবে, স্ত্রী পায়ের ওপর পা তুলে, বসে বসে সেই জল গিলবে, এমন অনাচার দেখেছে কেউ?’ এর পরও আছে! সেই তরুণীর স্বামী কিন্তু এর কয়েক দিনের মধ্যেই জামাইষষ্ঠীতে বউয়ের বাড়ি গিয়ে ষোড়শোপচারে যত্নআত্তি নিয়ে আসবে, ‘জামাই’ হওয়ার পুণ্যবলে।

বলি কী, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে পাখার হাওয়া না দিয়ে, এ বার থেকে ষষ্ঠীর আগে ‘জামাই’ শব্দটাকে ডিলিট করে, মেয়েদের জন্য সমান সম্মান আর আদর বরাদ্দ করি আমরা, আমাদের চেতনায়। দেখবেন, পারিবারিক, সামাজিক স্ফূর্তি তাতে একটুও কমবে না। আরও ঝলমলিয়ে উঠবে বরং।

Bengali festival jamai sasthi special
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy