Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নাটকই ছিল তাঁর অস্ত্র

মাদীহা গওহরকে অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক, নারীবাদী, সমাজকর্মী— এমন অনেক ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১২:০৬
Share: Save:

গত ২৫ এপ্রিল পাকিস্তান নাট্যজগতে এক ইন্দ্রপতন ঘটল। তিন বছর ক্যানসারের সঙ্গে সাহসী সংগ্রাম চালিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়লেন মাদীহা গওহর (ছবিতে)। চলে গেলেন তিনি, তবে বিজয়ীর মতো। ফেলে যাওয়া পথে পড়ে রইল অসংখ্য স্মারক, যা অর্জন করা মাত্র ৬১ বছরের জীবনকালে নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ।

মাদীহা গওহরকে অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক, নারীবাদী, সমাজকর্মী— এমন অনেক ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছে। আমরা ভারতীয়রা তাঁকে চিরকাল মনে রাখব এমন এক জন মানুষ হিসাবে, যিনি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাঁটাতারে লেগে থাকা সমস্ত কান্না, রক্তবিন্দুর উপর দিয়ে বহন করে নিয়ে এসেছেন শান্তির বার্তা। ভারতের অভিনয় এবং সংস্কৃতি জগতের বহু কৃতীর সঙ্গে স্থাপিত হয়েছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। দেশভাগ, যুদ্ধ, রাজনীতি, ঘৃণা, এ সব তাঁর ভালবাসার চিঠির খামে কখনও ঢুকতে পারেনি। এক প্রবীণ সাংবাদিক ঠিকই বলেছেন, “আমি এ যাবৎ যে ক’জন প্রাণবন্ত মানুষ দেখেছি, পাকিস্তানি নাট্যকার মাদীহা গওহর তাঁদের অন্যতম, যিনি নাটককে ব্যবহার করেছেন হিংসার বিরুদ্ধে, শান্তি এবং পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে।”

সব কিছুর উপর দিয়ে যে মাদীহা গওহর বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা কুড়োবেন, তিনি এক অসম্ভব সাহসী এবং দৃঢ়চেতা মহিলা। পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজের মাটিতে শিরদাঁড়া সোজা রেখে তিনি ‘স্বাধীন থিয়েটার’ নিয়ে লড়াই করেছেন সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। এই লড়াই মোটেই সহজ ছিল না। ১৯৫৬ সালে মাদীহার জন্ম করাচিতে। সেখানে ইংরেজিতে এমএ পাশ করে তিনি থিয়েটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে যান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। না, ও দেশে থেকে যাননি। নিজের দেশে ফিরে এসে নাটকের জন্য লড়াই শুরু করেন। সঙ্গে পেয়ে যান নাট্যকার, পরিচালক জীবনসঙ্গী শাহিদ নাদীমকে। দু’জন মিলে ১৯৮৪ সালে তৈরি করেন এক অসাধারণ নাট্যদল। নাম ‘আজোকা’। এই দল যে সব নাটক মঞ্চস্থ করেছে, সবেতেই বার্তা ছিল সুবিচার, মানবতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য অথবা নারী স্বাধীনতার। মাদীহা বেছে নিয়েছিলেন মূলত ‘ভান্ড’ এবং ‘নওটঙ্কি’ ফর্ম। সাধারণ দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষের হৃদয়ে পৌঁছনোর পক্ষে এই ফর্মগুলি আক্ষরিক অর্থেই কার্যকর হয়েছে।

মাদীহা গওহরের লড়াই ছিল, সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে মানবসমাজকে এক বৃহত্তর পরিসরে প্রবেশ করতে সাহায্য করার, যেখানে মানুষ মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত জীবনের স্বাদ পাবেন। এই লড়াইতে সার্থক অস্ত্র ছিল তাঁর নাটক। ‘আজোকা’ তার সাহসী প্রযোজনাগুলির জন্য বহু বার মৌলবাদীর রক্তচক্ষুর সামনে পড়েছে। তবু মাদীহা-রা মাথা নত করেননি। তাঁদের নাটকগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল ২০১০ সালে মঞ্চস্থ ‘বুরকাভাগানসা’। হাস্যরসের আঙ্গিকে এটি আসলে একটি “প্রেমের গল্প, যা সংগ্রাম করেছে চরমপন্থা, ক্ষমাহীনতা, উগ্রপন্থা ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে।” লিঙ্গ বৈষম্য, জেহাদ ও মৌলবাদ বিরোধী এই নাটকে বোরখার বিপুল ব্যবহার কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়কে নেতিবাচক ভাবে দেখিয়েছে বলে এক শ্রেণির ধর্মান্ধ ক্ষমতাবান মানুষ মনে করেছিলেন। ফলে নাটকটি ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত হয়। অবশ্য ‘আজোকা’ থেমে থাকেনি। একের পর এক নাটক নিয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন এশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। ভারতের কোনও শহরই প্রায় বাদ নেই। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ইরান, মিশর, ইংল্যান্ড, আমেরিকার মতো বহু দেশে। প্রত্যন্ত গ্রাম, শহরের রাস্তা, খোলা আকাশের নীচে নাটক করেছে ‘আজোকা’। যেন মানুষের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে মানুষের নাটক।

মাদীহা চলে গিয়েছেন। আমাদের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে বিপ্লবী ভগৎ সিংহ সম্পর্কিত নাটক, ‘মেরা রং দে বাসন্তী চোলা’ অথবা শাহজাহান পুত্র দারা শিকোহকে নিয়ে নাটক ‘দারা’। ‘তোবা টেক সিং’, ‘এক থি নানি’, ‘লেটারস টু আংকল স্যাম’, ‘হোটেল মহেঞ্জোদারো’ ইত্যাদি নাটকও দেশে-বিদেশে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। পাকিস্তান তাঁকে ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’, ‘তমঘা-এ-ইমতিয়াজ’, ‘ফাতিমা জিন্না অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে। ২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডস তাঁকে নাট্যদলের নেতৃত্ব দানের কারণে দিয়েছে সম্মানজনক ‘প্রিন্স ক্লস অ্যাওয়ার্ড’। ‘নোবেল’ পুরস্কারের জন্যও তাঁর নাম বিবেচনায় এসেছে। কিন্তু মাদীহার আসল প্রাপ্তি জনগণের স্বীকৃতি। এক অক্লান্ত যোদ্ধা, যিনি সুস্থ মুক্ত জীবনের দাবি নাটকের ভাষায় জানিয়ে বেড়িয়েছেন দেশে-দেশান্তরে— এ ভাবেই সম্ভবত ইতিহাস তাঁকে দেখবে। আর আমরা, ভারত-পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ, যাঁরা নিজেদের ভুলিয়ে রেখেছি বোমা-বন্দুকের দুর্বোধ্য ধাঁধায়, মাদীহা সেই আমাদের মধ্যে এক সংস্কৃতির সেতু বেঁধে দিয়ে গেলেন। পাকিস্তানি লেখক ও সাংবাদিক ওমর আর কুরেশির সঙ্গে আমরাও গলা মিলিয়ে বলতে পারি, “আজোকার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই সম্ভবত মাদীহা গওহরকে সকলে মনে রাখবেন, যাঁরা নাটক নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন— বার বার সেখানে গিয়ে এক মূল্যবান সেতু নির্মাণের কাজ করেছেন এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।” কামানের গোলাই কেবল সীমান্ত পেরোয় না, নাটকের বার্তাও পৃথিবীর যে কোনও কাঁটাতার অতিক্রম করতে পারে। মাদীহা গওহর সমকালকে সেই বার্তাই দিয়ে গেলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madeeha Gauhar Pakistani actress Passes away
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE