Advertisement
E-Paper

তার চেয়ে ‘বন্ধু’ হলেই হয়

ধুম জ্বরে সাত দিন বিছানায়। কলেজ কামাই। তাতে কী! বন্ধুরা আছে না! ওরাই তো এগিয়ে দেবে ক্লাস নোট‌্স-এর খাতা।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭ ১২:৫৯

ক্লাস এইটের পিছনের বেঞ্চ। ভূগোল ক্লাসে গুজগুজ, খিকখিক। দিদিমণি কথা বলা মেয়েটিকে দাঁড় করালেন। বকতে যাবেন, অমনি পুরো বেঞ্চ দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘আমরাও তো কথা বলেছি। আমাদেরও শাস্তি দিন।’

ধুম জ্বরে সাত দিন বিছানায়। কলেজ কামাই। তাতে কী! বন্ধুরা আছে না! ওরাই তো এগিয়ে দেবে ক্লাস নোট‌্স-এর খাতা।

বন্ধুরা আছে। তুমুল আনন্দে, খুচরো মনখারাপে, প্রচণ্ড কষ্টেও। ওই কাঁধগুলোয় নির্ভয়ে মাথা রাখা যায়। রাখার আগে জবাবদিহির টেনশন হয় না। ঠিকই বলেছেন আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক উইলিয়াম চোপিক— পরিবারের চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে থাকলেই মানুষ খুশি থাকে বেশি। মনের সঙ্গে ফুরফুরে থাকে শরীরও। এই নিখাদ আনন্দ পরিবারের গণ্ডির মধ্যে কোথায়?

আসলে, বন্ধুত্বের মাঝে ‘কর্তব্য’-এর খবরদারি থাকে না। থাকে না বলেই হয়তো তার এতখানি জোর যে, রক্তের সম্পর্ককেও হার মানাতে পারে। বন্ধুত্ব মানে দায় নেই, ভার নেই, বন্ধুত্ব মানে মুক্তি। প্রথম প্রেমের চোরা আনন্দ কিংবা প্রথম বিচ্ছেদের দমচাপা কষ্ট, ক’জন মা-বাবার সঙ্গে নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিতে পারে?

তখন স্কুলে নিচু ক্লাসে পড়ি। এক সিনিয়র দিদির মা মারা গেলেন। ক্লাসের দুই বন্ধু বিকেলে দেখতে গেল তাকে। তার প্রচণ্ড কষ্ট একটু কমাতে নানা রকম আবোল-তাবোল গল্প শোনাতে লাগল। কাজও হল। আস্তে আস্তে ওদের সঙ্গে যোগ দিল মেয়েটি। একটা সময় খিলখিলিয়ে হেসেও উঠল। তক্ষুনি ঝাপটে এলেন এক কাকিমা, ‘ওকে হাসাচ্ছ কেন? এটা কি ওর হাসার সময়? বরং একা বসে একটু মায়ের কথা ভাবুক।’ তফাতটা এখানেই। তফাতটা মন খোলার, জমে থাকা এক রাশ আনন্দ, কষ্ট, ভয়, মন-খারাপকে উগরে দেওয়ার স্বাধীনতার।

তফাত আরও আছে। বন্ধুত্বে কোনও প্রত্যাশা পূরণের চাপ থাকে না, যে চাপ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্তানের ওপর অত্যধিক। সন্তান সেখানে এক দিকে পরিবারের ‘অনুগত সৈনিক’, অন্য দিকে মা-বাবার গর্বের পুঁটলি। সেই নার্সারি থেকে শুরু— তার পর চলতেই থাকে আদর্শ সন্তান হয়ে ওঠার সংগ্রাম। ‘আদর্শ’ বন্ধু হয়ে ওঠার জন্য কেউ দিনরাত লড়ছে— এমনটা কি শোনা যায় কখনও? যে যেমন, সে তার মতো করেই বন্ধু বাছে। বনলে ভাল, না-বনলে অন্যমুখো হলেই হল। কারণ, সম্পর্ক তো এখানে জন্মসূত্রে তৈরি হয় না, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তৈরি হয়। প্রয়োজনে তা ভাঙে, আবার গড়ে। কিন্তু তিক্ত হয়ে গেলেও বছরের পর বছর শুধু কর্তব্যের খাতিরে সেই সম্পর্ককে বয়ে বেড়াতে হয় না। খারাপ-ভাল বেছে নেওয়ায় সেখানে অবাধ স্বাধীনতা। পরিবার আমাদের নিরাপত্তা দেয়, ঠিকই। কিন্তু বিনিময়ে এই স্বাধীনতার অনেকখানি কেড়েও নেয়।

তবে কি বন্ধু আর পরিবার দুই বিপরীত প্রান্ত! ভেবে দেখলে, তা নয়। বন্ধুত্বের মধ্যেও একটা পারিবারিকতা আছে। শুরুতে যে গল্পগুলো বলেছি, তা তো সেই পারিবারিকতারই গল্প। কিন্তু সে পারিবারিকতা দায়-হীন, নিয়ন্ত্রণ-হীন। পরিবার তো শুধু রক্তের সম্পর্ক দিয়ে গড়া নয়। ভালবাসা, স্নেহ, আবেগ— অনেক কিছু পরিবারের ধারণার সঙ্গে মিশে থাকে। বন্ধুরাও সেই বড় পরিবারেরই অংশ। ছোটবেলায় পরিবার যেমন তার নিজস্ব অভ্যেস আর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গড়ে সন্তানকে, বড় হয়ে বন্ধুরাও সেই একই কাজ করে নিঃশব্দে। একের ব্যক্তিত্ব, মতামত, স্টাইল অজান্তেই চারিয়ে যায় অন্যের ভেতর, ঠিক যেমন বড় দিদি বা দাদাকে অনুকরণের চেষ্টা করে ছোটটি। বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা প্রিয়জন-বিচ্ছেদের চেয়ে এতটুকু কম নয়। আবার অনেক বছর পর হঠাৎ পুরনো বন্ধুর খোঁজ পেলে সেই শিকড়ে ফেরার আনন্দই টের পাওয়া যায়।

একসঙ্গে সিনেমা দেখা, বই পড়া, রাজনীতি নিয়ে তর্ক— সব কিছুতেই যেমন আমরা পাশে বন্ধুকে খুঁজি, তেমন পরিবারকেও খুঁজি। কিন্তু অধিকাংশ মা-বাবা-দাদা-দিদিই ‘অভিভাবক’ হওয়ার রেখাটা পার করতে পারেন না। হয়তো চানও না। এই রেখাটা বন্ধুত্বে থাকে না। বন্ধুরা আমাদের সেই স্বপ্নের পরিবার, যেখানে সব কিছু উজাড় করে দেওয়া যায়, যেখানে কড়া নিষেধে বার বার পা আটকে যায় না, যেখানে বোকা বোকা চাওয়াগুলোকেও সবাই মন দিয়ে শুনতে তৈরি থাকে, অহেতুক রাগ, বকুনি ছাড়াই।

সন্তানের এই চাওয়াটা পরিবারকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে বন্ধুত্বের উদাহরণ থেকেই। সম্পর্কে দায়, কর্তব্যের মতো ভারী শব্দগুলো আদৌ থাকবে কি না, বা থাকলেও কতটুকু থাকবে, তা স্থির করার প্রাথমিক ভার থাকুক ছেলেমেয়ের ওপরই। ছোট থেকেই তাদের গড়ে তোলা হোক এক সহজ, সাবলীল, আনন্দের পরিবেশে। ছোটবেলা ফুরফুরে হলে ভবিষ্যতে মা-বাবাকে আনন্দে রাখার দায়িত্বটুকু তারা স্বেচ্ছায় তুলে নেবে। রক্ষণশীলদের বুক মুচড়ে উঠলেও এটা সত্যি যে, কড়া শাসন দিয়ে সন্তানকে আটকে রাখার সময় পেরিয়ে গেছে। উটপাখি হয়ে থাকলে পরিবারের ভাঙন আরও বাড়বে, কমবে না।

নিয়ম-নিষেধ তো অনেক হল, মা-বাবারা একটু ‘বন্ধু’ হয়েই দেখুন না!

Parents Children Friendship
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy