তেলের দাম যখন এমনই লাগামছাড়া বাড়িতেছে, তখন শুল্ক কমাইয়া দিলেই হয়। বিশেষত, ভারতে পেট্রোলিয়ামের উপর শুল্কের পরিমাণ বিপুল। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সেই পথ নাই। অর্থমন্ত্রী মুখে কুলুপ আঁটিয়াছেন। কিন্তু পরিসংখ্যানের মুখ বন্ধ করে, সাধ্য কাহার। অঙ্ক বলিতেছে, পেট্রোলিয়াম শুল্ক ছাড়িয়া দিলে ভারতীয় অর্থনীতি ঘোর বিপাকে পড়িবে, কারণ এই অর্থবর্ষে আয়কর ও কোম্পানি করে ভাটা পড়িয়াছে। এই অবস্থায় পেট্রোলিয়াম শুল্ক কমাইয়া রাজস্ব আদায় নিম্নমুখী হইলে তাহার প্রভাব পড়িবে রাজকোষ ঘাটতির অঙ্কে, এবং তাহার প্রতিক্রিয়া বিপুল। অতএব, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসই উঠুক আর মূল্যবৃদ্ধির হার ভয় দেখাইতেই আরম্ভ করুক, অর্থমন্ত্রক নাচার। এ ক্ষণে প্রশ্ন, ভারতীয় অর্থনীতিটিকে লইয়া চার বৎসরে তাঁহারা কী করিলেন যাহাতে এই অবস্থায় পৌঁছাইতে হয়? এখনও এক মাস কাটে নাই, কেন্দ্রীয় সরকার বুক ঠুকিয়া বলিয়াছিল, আয়কর দাতার সংখ্যা বিপুল হারে বাড়িয়াছে— গত বারের তুলনায় ৭১ শতাংশ বৃদ্ধি। দেখা গেল, সেই সংখ্যা বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রদত্ত করের পরিমাণ শূন্য বা যৎকিঞ্চিৎ। অর্থাৎ যাঁহাদের আয় কায়ক্লেশে করযোগ্য, অর্থমন্ত্রক তাঁহাদের আয়করের আওতায় আনিতে সফল। নোট বাতিলের মহাতাণ্ডবের সুফল বলিতে তবে এইমাত্র? কালো টাকা ধরা পড়িল না, সন্ত্রাস কমিল না, এমনকি আয়কর আদায়ের পরিমাণও বাড়িল না— গোটা দেশকে তুর্কিনাচন নাচাইবার প্রাপ্তি বলিতে তবে হাতে থাকিল কী?
অগস্টের শেষ অবধি কোম্পানি কর আদায়ের পরিমাণ সাকুল্যে এক শতাংশও বাড়ে নাই। কোম্পানিগুলির অবস্থা এই বৎসর খারাপ নহে। তাহা হইলে সমস্যা কোথায়? অর্থমন্ত্রক ফের চুপ। অভিজ্ঞজনেরা বলিতেছেন, সমস্যা বাধাইয়াছে রিটার্ন। অভিযোগ, গত অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমাইয়া দেখাইতে কর বাবদ আদায় করা বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়া হয় নাই। এই অর্থবর্ষে সেই টাকা মিটাইতেই আদায়ের সিংহভাগ গলিয়া যাইতেছে। বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম চার মাসেই যত টাকা রিটার্ন দেওয়া হইয়াছে, তাহা বিগত অর্থবর্ষের মোট রিটার্নের অর্ধেক। তাহার ফল, গত বৎসরের কোম্পানি কর বাবদ আদায় হওয়া ৫৬৩৭৪৫ কোটি টাকাকে বাড়াইয়া ৬২১০০০ কোটি টাকায় লইয়া যাওয়ার যে লক্ষ্য বাজেটে নির্দিষ্ট হইয়াছিল, তাহাতে পৌঁছানো কার্যত অসম্ভব হইয়াছে। অভিযোগটি যদি সত্য হয়, তাহা হইলে নরেন্দ্র মোদীরা স্বখাতসলিলে পড়িয়াছেন। বারে বারে যে অভিযোগ শোনা যায়, সেই স্বচ্ছতার অভাবই তাঁহাদের ডুবাইতেছে।
মূল কথা হইল, ভুল পরিচালনার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি ডুবিতে বসিয়াছে। সরকার যত চেষ্টাই করুক, আশঙ্কা হয়, এই দফায় রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়িবে। সেই দায়টি বিলক্ষণ পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির ঘাড়ে চাপাইয়া দেওয়া হইবে। কিন্তু, তেলের দাম যে অনন্ত কাল তলানিতে থাকিবে না, সরকারের সেই কথাটি ভোলা উচিত হয় নাই। তেলের দাম হইতে শুল্ক তুলিয়া লওয়ার মধ্যে আলস্যের আরাম বিলক্ষণ আছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে, তখন শুল্ক বাড়িলেও তাহার আঁচ উপভোক্তার গায়ে লাগে না। দ্বিতীয়ত, এই শুল্ক ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। ফলে, হাতে-গরম রাজস্বের উৎস হিসাবে পেট্রোলিয়ামের বিকল্প পাওয়া ভার। সমস্যা হইল, তাহার উপর নির্ভরশীলতা বেলাগাম হইলে ফিরিবার আর পথ থাকে না। আয়কর এবং কোম্পানি কর, রাজস্বের এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসকে যথাবিধি গুরুত্ব না দেওয়া, এবং অস্বচ্ছতার দাম এখন দিতে হইতেছে পেট্রল পাম্পে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy