Advertisement
E-Paper

বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনায়াসে তাঁহার প্রতিপক্ষ দলের তর্জনগর্জনকে কুকুরের ডাকের সহিত তুলনা করেন। মনমোহন সিংহ বিষয়ে শব্দ নির্বাচন করেন: রাতপ্রহরী। কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধী বিষয়ে উপমার শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন: ‘জার্সি গরু’ অর্থাৎ বিদেশি ছাপযুক্ত গরু।

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:১৪

রাজনীতির ভদ্রতা আপাতত একটি বিগত যুগের স্মৃতি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কথা শুনিয়া তাই স্মৃতিভারে জর্জরিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ২০১৪ সালে বলা নিজেরই একটি উক্তি স্মরণ করিতে গিয়া মনমোহন সিংহ আক্ষেপ করিয়াছেন যে সেই কথায় একটি ‘উগ্র’ শব্দ ছিল, উহা ব্যবহার করা সেই দিন উচিত কাজ হয় নাই! বিজয়ী বিজেপি প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে পরাজিত প্রার্থী মনমোহন সিংহের সে দিনের ‘উগ্র’ শব্দটি ছিল ‘ডিজ়াস্টার’! তাঁহার আক্ষেপ শুনিয়া কপালে করাঘাত করিয়া নস্টালজিয়ায় ডোবা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাস্তবিক, তাঁহার ‘উগ্র’ শব্দটি যে সে দিন সুপ্রযুক্ত ছিল— মনমোহন সিংহের মন্তব্যে শ্রোতার নস্টালজিয়াই তাহার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। এমন একটি সামান্য শব্দ ব্যবহারে দুঃখিত বোধ করিবার মতো প্রধানমন্ত্রী এই দেশে আপাতত আশাতীত। এক নরেন্দ্র মোদীই গত সাড়ে চার বৎসরে ভারতীয় নাগরিককে ভুলাইয়া দিয়াছেন যে— রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মানেই শত্রু নহে, ভিন্নমতাদর্শী মানেই অপমান ও অসম্মানের লক্ষ্য নহে, বিরোধী পক্ষ হইলেই তাহার বিরুদ্ধে অশোভন শব্দের বন্যা বহাইয়া দিতে হয় না, প্রতিশোধের রাজনীতির মাধ্যমে বিরোধীর রাজনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করিবার ‘মহতী’ কৃষ্টির চর্চাই একমাত্র রাজনীতি নয়। মনমোহন সিংহের প্রস্থান ও নরেন্দ্র মোদীর আগমনের সহিত ভারতীয় রাজনীতি হইতে একটি বস্তু কার্যত বিলুপ্ত হইয়াছে। তাহার নাম শোভনতা।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনায়াসে তাঁহার প্রতিপক্ষ দলের তর্জনগর্জনকে কুকুরের ডাকের সহিত তুলনা করেন। মনমোহন সিংহ বিষয়ে শব্দ নির্বাচন করেন: রাতপ্রহরী। কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধী বিষয়ে উপমার শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন: ‘জার্সি গরু’ অর্থাৎ বিদেশি ছাপযুক্ত গরু। এবং প্রধান প্রতিস্পর্ধী রাহুল গাঁধী সম্পর্কে ব্যঙ্গ করিয়া বলেন: সংকর প্রজাতির গোবৎস। বলা বাহুল্য, এই সব শব্দের ব্যবহারে তিনি নিজেই উল্লাসে মাতোয়ারা হন। তিনি নাকি অন্তত কুড়ি জনকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছেন যে সনিয়া গাঁধীকে কেরানি হিসাবে নিয়োগের যোগ্য বলিয়াও তাঁহারা মনে করেন না। অবশ্যই, দলীয় সদস্যরা নেতৃমুখে এই সব কথা শুনিয়া দ্বিগুণ উৎসাহে প্রজ্বলিত হইয়া ওঠেন, নেতার জয়হুঙ্কারে মাতেন। কেনই বা মাতিবেন না। জবরদস্ত রাজনীতির ভাষা বলিতে তাঁহারা তো এই সব শব্দ ব্যবহারের শিক্ষাই পাইয়াছেন— যত বেশি অভদ্র কথা, এমনকী ঘৃণ্য গালাগালির ব্যবহার, ততই উন্মাদনা, ততই জনতুষ্টি।

বাস্তবিক, জনগণের তুষ্টিবিধানের ব্যাকরণটি এই ভাবেই পুনর্নির্মাণ করেন জনপ্রিয়তামুখী রাজনীতিকরা। ভোট সব নেতাই চাহেন, কিন্তু কোনও কোনও রাজনীতি ও রাজনীতিকের বৈশিষ্ট্য এই যে তাঁহাদের আদর্শ বা নীতি লইয়া বলিবার বিশেষ কিছু থাকে না বলিয়া লোক খেপাইবার জন্য উত্তেজক শব্দের পিছনে ছোটাই তাঁহাদের নিকট প্রেয় ও শ্রেয় ঠেকে। বিপক্ষ কেন, নিজের দলের অগ্রজ নেতা বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী কেমন রুচির কথা বলিতে পারেন, তাহা লালকৃষ্ণ আডবাণী বিলক্ষণ জানেন। শোভনতার এই বিস্তীর্ণ বধ্যভূমিতে দাঁড়াইয়া মনমোহন সিংহেরা তাই এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির দৃষ্টান্তে পরিণত— দিন অবসানের অপেক্ষায়।

Manmohan Singh Narendra Modi Politeness
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy