Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আজকের জনপ্রিয় নেতা মানে শক্তিশালী সুপারম্যান

অ নেক দিন পর সে দিন সন্ধ্যায় পুরনো দিল্লির জামা মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ হচ্ছিল। প্রশস্ত বারান্দা থেকে গোধূলির লাল কেল্লা দেখতে খুব ভাল লাগছিল। সংকীর্ণ কর্মব্যস্ত রাস্তা।

মিলনতীর্থ: দিল্লির জামা মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলে কয়েক শতক ধরে হিন্দু মুসলিম জৈন সব ধর্মের মানুষের বাস। ঈদ, অক্টোবর ২০১২। গেটি ইমেজেস

মিলনতীর্থ: দিল্লির জামা মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলে কয়েক শতক ধরে হিন্দু মুসলিম জৈন সব ধর্মের মানুষের বাস। ঈদ, অক্টোবর ২০১২। গেটি ইমেজেস

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

অ নেক দিন পর সে দিন সন্ধ্যায় পুরনো দিল্লির জামা মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ হচ্ছিল। প্রশস্ত বারান্দা থেকে গোধূলির লাল কেল্লা দেখতে খুব ভাল লাগছিল। সংকীর্ণ কর্মব্যস্ত রাস্তা। মসজিদের উল্টো দিকেই করিমের মোগলাই খানার পুরনো দোকান। বিশাল মসজিদের পিছনেই জৈন গলি। বারাণসীর গলির মতোই। বিশুদ্ধ শাকাহারী ভোজনালয়। মুঘল সময়ের বগলা মায়ের মন্দির। প্রাচীন গৌরীশঙ্কর মন্দির, দুর্গা মন্দির। গায়েই চাঁদনি চকের ঐতিহাসিক শিসগঞ্জ গুরুদ্বারা। দিল্লির বিজেপি নেতা আজকের ক্রীড়ামন্ত্রী বিজয় গোয়েলদের পারিবারিক হাভেলি এই গলিতেই। বিজয়ের বাবা ছিলেন দিল্লির স্পিকার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই হাভেলিটিকে বিজয় বানিয়েছেন হোটেল-রেস্তোরাঁ। বিজেপি নেতার এই হোটেলে দেখলাম, মুসলমান পর্যটকও কম নয়। এলাকাটি আজও তাই হিন্দু-মুসলিম দুই জনগোষ্ঠীর এক অদ্ভূত মিলনক্ষেত্র। চুড়ি পরিহিত ঘোমটা দেওয়া হিন্দু নারী, বোরখা পরিহিতা মুসলিম নারী—গলিতে বাজার করছেন দু’জনেই।

ইতিহাস বলে মুঘল আমলে এই গলিতে ধনী জৈনরা থাকতেন। সেখানে গরিব মুসলমানেরা ছিল তাদের কর্মচারী। আজও দেখলাম সোনার দোকানের জৈন মালিক ও মুসলমান কারিগর। জামা মসজিদের সামনে সাদা টুপি আর চেক চেক লুঙ্গি পরা আনওয়ার সাহেব সাদা দাড়িতে আতর লাগিয়েছেন। তিনি আজও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের ভক্ত, বললেন, ‘১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে নবাব রোহিলখণ্ডের ঘোষণাপত্রে বলেছিলেন, ইংরেজরা হিন্দুস্থানের বাসিন্দাদের প্রতারিত করছে। আমরা নিজেদের অস্ত্র নিজেদের গলায় চালাচ্ছি। ইংরেজরা মুসলমানদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে আর হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাতে চেষ্টা করাবে। ভাইসব, এই জালে পড়বেন না।’ আনওয়ার অবশ্য বিপান চন্দ্রর কথা জানেন না। বিপান চন্দ্র মনে করেন, সাম্প্রদায়িকতাবাদ মধ্যযুগ থেকে চলে আসছে এমন নয়। ভারতে সাম্প্রদায়িকতা এক আধুনিক মতাদর্শ।

তাই বলে কি মুঘল আমলে কোনও দাঙ্গাই হয়নি? ১৭২৯ সালে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার সময়ে বাদশা মহম্মদ শাহের নাকের ডগায় এই জামা মসজিদের একেবারে সামনে প্রচণ্ড দাঙ্গা হয়। নীরদ চৌধুরীর আত্মজীবনীতে তার উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘শনি ছিদ্র না থাকিলে প্রবেশ করিতে পারে না।’

নরেন্দ্র মোদী নতুন ভারত গড়বেন বলেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রথমে কসাইখানা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নিরামিষ-রাজ্য গঠনের কথা বললেন। রাজস্থানের অলওয়রে গো-রক্ষক বাহিনীর অভিযান চলল। কলকাতার রাজপথে সশস্ত্র রামনবমী হল। এই কি সেই নতুন ভারত? মনে হচ্ছে ২০১৭ সালে শনি আবার ছিদ্র খুঁজে পেয়েছে।

আরএসএস খাকি হাফ প্যান্টের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল মুসোলিনির কাছ থেকে। হিটলার-মুসোলিনি অতীত রক্ষণশীল মতাদর্শের ভিত্তিতে মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলেন। ইহুদিবিরোধিতা মধ্যযুগ থেকে এলেও কিন্তু নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি বিরোধিতা অতীতের কোনও তত্ত্বের পুনরুজ্জীবন ছিল না। সেটি ছিল আধুনিক মতাদর্শ। সঙ্ঘের নেতারাও বুঝতে পারছিলেন ভারতকে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ হিন্দু-রাষ্ট্র বলে জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। বরং সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা হিন্দু সমাজকে অনুপ্রাণিত করতে পারবে।

নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতীয় সাধারণ মানুষের এক বড় অংশের কাছে অবতার। জনপ্রিয়। স্বপ্নপূরণের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। আগে জনপ্রিয় নেতা কেমন হত জানেন? আনন্দবাজারের দিল্লির সাংবাদিক খগেন দে সরকার ভিয়েতনামে যান হো চি মিনের সঙ্গে দেখা করতে। মাটির বাড়ির দাওয়ায় খালি গায়ে লুঙ্গি পরে হো চি মিন বসে আছেন। তাঁকে দেখে তো প্রথমে খগেনদা চিনতেই পারেননি। অথচ ভিয়েতনামে তখন হো চি মিন জনপ্রিয়তম নেতা। সেই অনাড়ম্বর জীবনযাত্রাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। আজ জনপ্রিয় নেতার বৈশিষ্ট্য বদলে গিয়েছে। আজ জনপ্রিয় নেতা ঠিক আমার প্রতিবেশী জ্যাঠা বা কাকার মতো নয়। তিনি আমার থেকে আলাদা। এখন জনপ্রিয় নেতার মধ্যে আমার কিছু উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে তিনি আমার বিপরীত। তিনি আমার মতো দুর্বল নন। তিনি প্রবল শক্তিশালী এক সুপারম্যান।

নরেন্দ্র মোদীর ভারত ভাবনার উপসর্গগুলি আপনার পছন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে এ দেশের বহু মানুষ এখনও তাঁকে বিশ্বাস করছেন। তিনি এক দিকে গরিবের কল্যাণ করবেন এমন বিশ্বাস বহু ভারতীয়ের। এই পপুলিজমের রাজনীতির সঙ্গেই মোদী মিশিয়েছেন আরএসএসের হিন্দু ভারত সম্পর্কিত প্রাচীন মতাদর্শ। তাতে আপাতত মোদী সাফল্যও পাচ্ছেন। এই পপুলিজমের রাজনীতি এক মোহাবিষ্ট গণতন্ত্র। মেরুকরণের রাজনীতি যে নির্বাচিত সরকারের একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে, যা উদার গণতন্ত্রের বহুত্ববাদী ভাবনার বিপরীত তা এখনও বহু মানুষ বুঝছেন না। বুঝছেন না কারণ ধর্মোন্মাদনা।

কুসংস্কার বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। লন্ডনে ২০৬৮ জনের উপর এক সমীক্ষা হয় কুসংস্কার নিয়ে। তা থেকে জানা যায় শতকরা ৭৪ ভাগ শিক্ষিত ব্রিটিশ কাঠ স্পর্শ করলে মনে করেন বিপদ-আপদ হবে না (টাচ উড)। মোদীও আজ এমনই এক রাজনৈতিক কুসংস্কার। দুর্বলচিত্ত বেকারি-দারিদ্র জর্জরিত মানুষ মোহাবিষ্ট, এই অবতারবাদে আচ্ছন্ন। বলছেন, রামনবমী থেকে নানা লোকাচার, চলুন, আমরা হিন্দুধর্মকে ক্যাথলিক চার্চ বা মক্কা-মদিনার ধাঁচে একটি শক্তপোক্ত অনুশাসনের কাঠামোয় পরিণত করি। ভারতকে পাকিস্তানের মতো ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করি। হিন্দু-রাষ্ট্রের পতাকা তুলি।

অথচ হিন্দু ধর্ম কিন্তু কোনও কালেই ব্যক্তিনির্ভর নয়। যিশুকে বাদ দিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম কল্পনা করা যায় না, জরথুষ্ট্র ও বুদ্ধ ছাড়া তাঁদের ধর্ম হয় না। হিন্দু ধর্মে কিন্তু কোনও এক জন অবতার বা ধর্মগুরুর সর্বগ্রাহিতা নেই। এই ধর্ম নেতি নেতি করতে করতে এগোয়নি, ইতি-ইতি করতে করতে সকলকে নিয়ে এগিয়েছে। সেটাই ভারত সন্ধানের পথ। সঙ্ঘ দাবি করে ঋগ্‌বেদের যুগ থেকেই হিন্দুরা একটি জাতি। তা নয়। নানা জাতির সংমিশ্রণে আমাদের হিন্দু জাতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদে ক্লান্ত পৃথিবীর মানুষ গণতন্ত্র চেয়েছিলেন। নানা দেশে তখন থেকে গড়ে ওঠে উদার গণতন্ত্র। আজ সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরেছে। মানুষ আবার বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে পড়ছেন। এখন আবার তাঁরা রক্ষণশীল নেতা খুঁজছেন, যিনি জনদরদি হয়ে ধনীতন্ত্রকে খতম করে মানুষের কল্যাণ করতে পারবেন। কিন্তু রক্ষণশীল জাতি-রাষ্ট্রের এই অবতার-নেতার বিজ্ঞাপনে কত দিন মুখ ঢেকে থাকব আমরা? অনুসরণ করব কাকে? রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ না গোলওয়ালকর? রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্র না সাভারকর? গাঁধী, নাকি গডসে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Political Leader Power Populairity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE