এক সন্তানসম্ভবা নারীর গর্ভপাত করানোর আর্জিতে সায় দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি পুরনো বিতর্ককে আবার সংবাদ শিরোনামে নিয়ে এলেন। ডাক্তারিশাস্ত্র মতে, গর্ভস্থ ভ্রূণ যত দিন মায়ের শরীরের বাইরে স্বাধীনভাবে (অবশ্যই যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়) বাঁচার ক্ষমতা অর্জন না করছে তত দিনের মধ্যে গর্ভ নষ্ট হলে তাকে গর্ভপাত বলে। আধুনিক প্রযুক্তির হিসেবে এই সীমা ২৮ সপ্তাহ, যখন ভ্রূণের ওজন কমবেশি ১ কিলোগ্রাম। বিভিন্ন দেশে কিন্তু আইনানুগ কৃত্রিম গর্ভপাতের সীমা বিভিন্ন। ভারতে যেমন ২০ সপ্তাহ।
ভারতে যে-সব ক্ষেত্রে গর্ভপাত আইনানুগ তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হল, বর্তমান গর্ভের কারণে মায়ের শরীর-মন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। গর্ভস্থ সন্তান দুরারোগ্য কোনও ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে চলেছে জানতে পারলে সেই গর্ভকে বহন করে চলা মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অবশ্যই পীড়াদায়ক। তা ছাড়া সেই অনাগত সন্তানের কারণে তার পরিবার যে দূরপ্রসারী আর্থিক ও মানসিক দুর্গতির মুখে পড়ে, তা বিবেচনা করলেও এমন গর্ভপাত শ্রেয়। কিন্তু মুশকিল, বর্তমানে লভ্য প্রযুক্তিতে গর্ভস্থ সন্তানের যাবতীয় জটিল ত্রুটি ২০ সপ্তাহের মধ্যে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যা বারাসতের এই দম্পতির ক্ষেত্রে হয়েছে। ৩৩ বছর বয়সি মহিলা প্রথম মা হতে চলেছিলেন, এই গর্ভসঞ্চার তাঁদের পরিকল্পিত এবং অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু সব হিসেব গোলমাল করে দেয় ২১তম সপ্তাহের রোগনির্ণয়— হৃদযন্ত্রের এক দুরারোগ্য গঠনগত ত্রুটি। আগের যুক্তিতে এই গর্ভপাত তর্কাতীতভাবে শ্রেয়। অথচ মাত্র কয়েক দিন বা সপ্তাহের হেরফেরে এই গর্ভপাত আইনের চোখে অবৈধ হয়ে গেল, যদিও এই বিলম্বের জন্য হবু বাবা-মা দায়ী নন, দায়ী প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা। সুতরাং আদালতের অনুমোদন শুধু ব্যক্তিগত স্তরে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে নয়, দেশের চিকিৎসক-সমাজকর্মীসহ সকল সচেতন মানুষকেই স্বস্তি দিয়েছে। সম্প্রতি মায়ের জীবনসংশয় দেখা দেওয়ায় ২৩ সপ্তাহের এক ভ্রূণমোচনেও আদালত সম্মতি দেয়, অনুমতি দেয় এক ধর্ষিতার ২৪ সপ্তাহের গর্ভপাতেও। ক্যাথলিক আয়ার্ল্যান্ডে গর্ভপাত নিষিদ্ধ থাকায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত দন্ত-চিকিৎসক সবিতা হালাপ্পানাভা মৃত ভ্রূণ প্রসব করে সংক্রমণের কারণে নিরুপায় মৃত্যু বরণ করেন। কয়েক বছর আগের সেই দগদগে স্মৃতির পাশে আমাদের বিচারব্যবস্থার মানবিক মুখ নিশ্চয় আশ্বস্ত করার মতো।
কিন্তু কিছু প্রশ্নের অবকাশও থেকে যাচ্ছে। ভ্রূণের ঠিক কতটা সমস্যা নির্ণীত হলে আইনের চোখে সেই ভ্রূণকে গর্ভে ধরে রাখা ‘অতীব যন্ত্রণাদায়ক’ এবং তার জন্য গর্ভপাতের বিধিবদ্ধ সময়ের সীমা শিথিল করা যাবে সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা কিন্তু পাওয়া গেল না। ধোঁয়াশা আরও বাড়ছে অনতিকাল পূর্বের আর একটি রায়ের কারণে। সেখানে সন্তানের অপরিণত মানসিক বিকাশ প্রায় অবধারিত জানা সত্ত্বেও ২০ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ায় ‘ডাউন সিনড্রোম’ নামে এক নিরাময়-অযোগ্য জিন-বাহক ভ্রূণের গর্ভমোচনের প্রার্থনা এই সুপ্রিম কোর্টই ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বলার আছে অন্য বিষয়েও। মায়ের মানসিক অসুস্থতা শুধু কি তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের শারীরিক দুঃসংবাদেই সীমাবদ্ধ? ধরা যাক, ভ্রূণের ২০ থেকে ২৮ সপ্তাহ সময়কালে যদি তার পিতার মৃত্যু হয়, অথবা তার মা মনে করেন বর্তমান দাম্পত্য সম্পর্ক তিনি ছিন্ন করতে চান, তবে তখন সেই ভ্রূণের উপস্থিতিও কি গর্ভধারিণীর পক্ষে ‘অতীব যন্ত্রণাদায়ক’ নয়? এই মহিলা যদি এ বার গর্ভপাতের অনুমতি চান তখনও কি আমাদের আদালত তাতে সায় দেবেন? তখনও কি এ বারের মতো আমরা আদালতের উচ্চারণ শুনতে পাব, ‘সন্তান প্রসব করা বা না করা নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার’ অথবা ‘সব মহিলারই নিজের শরীরের উপর অলঙ্ঘনীয় অধিকার রয়েছে’?
গর্ভপাত সংক্রান্ত আমাদের দেশের ১৯৭১ সালের আইনটি সংশোধন করার, বিশেষত নির্ধারিত সময়সীমা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিধান মেনে অন্তত ২৪ সপ্তাহ অবধি বাড়ানোর এক প্রস্তাব ২০১৪ সাল থেকে সংসদের বিবেচনাধীন। আশা করি, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আমাদের আইন প্রণেতাদের এ বার দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
আমরা বরং অন্য সমস্যার কথাও ছুঁয়ে যাই। দেশের অতি সাধারণ নাগরিকের পক্ষে আদালতের দরজা অবধি পৌঁছনোর আর্থিক, সামাজিক, ভৌগোলিক ইত্যাদি নানাবিধ বাধার কথা যে বহু আলোচিত, তা আর এক বার স্পষ্ট করল এই মামলা। যথেষ্ট আলোকপ্রাপ্ত এবং সম্পন্ন এই দম্পতি উপযুক্ত আইনজীবীর মাধ্যমে দেশের শীর্ষ আদালতের কাছে তাঁদের এই যে সমস্যাটির কথা তুলেছেন, দেশের কত শতাংশ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব? সেই আপশোসকে সরিয়ে রেখে বলি আর এক আপশোসের কথাও। সংশ্লিষ্ট পরিবারটি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, “সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার পর থেকে ৪৪ দিন” রায়ের জন্য তাঁদের উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষার কথা। কিন্তু শুধু তো উৎকণ্ঠা নয়, এই সময়ে প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়েছে গর্ভস্থ ভ্রূণের আয়তন এবং সমানুপাতে বেড়েছে অন্তঃসত্ত্বার গর্ভপাত-জনিত স্বাস্থ্যহানি বা জীবনসংশয়ের আশঙ্কাও। এই মহার্ঘ ও মারাত্মক কালক্ষেপ কি এড়ানো যেত না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy