Advertisement
E-Paper

মোদী পিছিয়ে এলেন কেন

বিশ্বজিৎ ধর

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৬
বিক্ষোভ: ভারতের আরসিইপি-তে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের আন্দোলন। ৪ নভেম্বর, বেঙ্গালুরু। এএফপি

বিক্ষোভ: ভারতের আরসিইপি-তে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের আন্দোলন। ৪ নভেম্বর, বেঙ্গালুরু। এএফপি

সবাইকে অবাক করে ভারত ১৬টি দেশের রিজিয়নাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াল। আরসিইপি-র তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চুক্তিতে সই করার আগে পাকাপাকি কথা বলে নেওয়ার জন্যই ডাকা হয়েছিল সম্মেলনটি। সম্মেলন শেষে জানা গেল, চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত।

ক’দিন আগেও দেশের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী এই চুক্তির পক্ষে গলা ফাটাচ্ছিলেন। কী এমন হল যে ভারতকে সরেই দাঁড়াতে হল আরসিইপি চুক্তি থেকে? কৃষক থেকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, বণিকসভা থেকে নাগরিক সমাজের হরেক প্রতিষ্ঠান— ভারতে কার্যত প্রতিটি প্রান্ত থেকে এই চুক্তির বিরোধিতা হচ্ছিল প্রবল। এই চুক্তির ফলে বাণিজ্যের উদারীকরণ হলে দেশের অর্থনীতিতে তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে, এই ছিল আপত্তির মূল কথা। ভারতে বাণিজ্যিক উদারীকরণ হয়েছে ঠিকই, তবু বেশ কিছু ক্ষেত্রে আড়ালও রাখা হয়েছে। কৃষিতে, নির্মাণশিল্পের কিছু ক্ষেত্রেও। ভারতে এখন বেশির ভাগ পণ্যের ওপরই আমদানি শুল্ক তুলনায় কম; কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক মাঝারি রকম চড়া। ভারতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্যের বাজারের প্রতিযোগিতায় তাঁরা পেরে উঠবেন না, মূলত এই যুক্তিতেই ভারত চিরকাল কৃষিক্ষেত্রে বাণিজ্যিক উদারীকরণের থেকে দূরে থেকেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিতেও ভারত কৃষিপণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করেনি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তিতেও নয়। আসিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দেশ, কোরিয়া ও জাপান, কোনও দেশের সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্যিক চুক্তিতে কৃষিপণ্য নেই।

কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ভারত উদার বাণিজ্যের পথে হাঁটবে না, এই কথাটা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। আরসিইপি চুক্তি হলে এই জায়গাটায় মস্ত ধাক্কা লাগত। ‘গাইডিং প্রিন্সিপলস অব আরসিইপি’ নামক নথিটি কার্যত এই চুক্তির মূল সুর বেঁধে দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘যে কোনও পণ্যেই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব শুল্ক এবং শুল্ক-বহির্ভূত বাধা (ট্যারিফ অ্যান্ড নন-ট্যারিফ বেরিয়ার) দূর করতে সক্রিয় হবে আরসিইপি’ এবং এই চুক্তির ফলে ‘আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে বড় মাপের সংস্কার হবে’। অর্থাৎ, এই চুক্তির শরিক হলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কথা ভেবে কৃষিপণ্যের মতো কোনও একটি বাণিজ্যের পথে আমদানি শুল্কের বাধা তৈরি করার কোনও পথ ভারতের সামনে থাকবে না।

এই চুক্তির আরও একটি ফল হল, ভারতের বাজারে চিনেরও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এই কথাটিতেই ভারতীয় শিল্পমহলে বিপদঘণ্টি বেজেছে। চিনের সস্তা পণ্যের সঙ্গে পেরে ওঠা তাদের পক্ষে দুষ্কর। গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের বাজারে চিনের মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ১,১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭,৬০০ কোটি ডলারে। আরসিইপি-তে সই করলে চিনের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমাতেই হবে। ভারতীয় বাজারে চিনের দখল আরও বাড়বে, তা প্রায় নিশ্চিত।

আরসিইপি চুক্তিতে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজ়িল্যান্ড থাকার ফলে কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর আমদানি শুল্কের প্রশ্নটি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দুই দেশেরই রফতানিতে কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের উপস্থিতি প্রবল। অস্ট্রেলিয়ার রফতানির একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে গম ও চিনি— ভারতে যে দুটো পণ্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিপুল। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে ভারতের নামে নালিশ ঠুকেছে— আখ উৎপাদনের ওপর ভারত যে ভর্তুকি দেয়, তা কৃষিবাণিজ্যের চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে বলে। আরসিইপি-র আরও তিন শরিক দেশ, চিন, ইন্দোনেশিয়া আর তাইল্যান্ডও এই মামলায় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছে। ভারত যাতে আখচাষের ওপর ভর্তুকি কমায়, এই দেশগুলো তার জন্য চাপ তৈরি করতে চায়। এ দিকে, ভর্তুকি কমলে ভারতীয় আখচাষিরা বিপন্ন হবেন। চাষ কমবে। তখন এই দেশগুলো ভারতে চিনি রফতানি করে সেই ঘাটতি মেটাবে। এই অবস্থায় ভারত আরসিইপি-তে যোগ দিলে দেশগুলোর সুবিধা আরও বাড়ত।

দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের রফতানির পরিমাণে গোটা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজ়িল্যান্ড। তার ওপর, ভারতের ছোট উৎপাদকদের তুলনায় নিউজ়িল্যান্ডে লিটারপ্রতি দুধ উৎপাদনের খরচ কম। ফলে, ভারত আরসিইপি-তে যোগ দিলে নিউজ়িল্যান্ডের দুগ্ধজাত পণ্য ভারতের বাজারে দেশীয় পণ্যের তুলনায় কম দামে বিক্রি হত।

ভারতের পক্ষে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হল, এখন কৃষি ও শিল্প, দুই ক্ষেত্রেই গতিভঙ্গ হয়েছে। এই অবস্থায় বিদেশি পণ্যের জন্য হঠাৎ ভারতীয় বাজারের দরজা হাট করে খুলে দিলে দেশীয় ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ত। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ত শ্রমের বাজারে। ফলাফল হত মারাত্মক।

লক্ষণীয়, আরসিইপি-র ভিতরেই হোক বা বাইরে, ভারতের কৃষি এবং নির্মাণশিল্পকে যে বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে আড়াল করা প্রয়োজন, এই কথাটা সরকার দীর্ঘ দিন ধরেই জানে। আরসিইপি-র কথাই ধরা যাক। ২০১৫ সালে ভারত বাণিজ্য উদারীকরণের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটা জনসাধারণের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রস্তাবে ভারতের অবস্থান ছিল যথেষ্ট রক্ষণশীল। বলা হয়েছিল, আসিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির থেকে যত পণ্য আমদানি করা হবে, তার ৮০ শতাংশের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো হবে, কিন্তু চিনের থেকে যে আমদানি হবে, তার ৪২.৫ শতাংশের ওপর শুল্ক কমবে। একটু আগে ভারতীয় নির্মাণশিল্পের যে বিপন্নতার কথা বললাম, এই সিদ্ধান্তে তার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা থাকত। এর পর ভারত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে, আরও অনেক বেশি শুল্ক কমাতে সম্মত হয়। এখানে দুটো আপত্তি আছে। এক, ভারতকে তার প্রাথমিক অবস্থান থেকে সরে আসতে হল কোন পরিস্থিতিতে, তা একেবারেই স্পষ্ট নয় কেন; দুই, সরকার নতুন যে প্রস্তাবটি পেশ করল, তাকে কেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হল না?

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই ভারতে বাণিজ্যিক উদারীকরণ হতে থাকবে, এই নীতি থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৭ সালে সরে আসে। আরসিইপি চুক্তি বলে, শেষ অবধি প্রত্যেকটি দেশকেই আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। কাজেই, ভারত কী যুক্তিতে এত দিন এই চুক্তির আলোচনার প্রক্রিয়ায় ছিল, সেটাই আশ্চর্যের। ২০১৭ সালে ভারতে নির্মাণক্ষেত্রের পণ্যের ওপর গড় আমদানি শুল্ক ছিল ১১%। নির্মাণক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশের দাবি মেনে ২০১৮ সালে এই গড় শুল্ক বেড়ে দাঁড়ায় ১৪%। কৃষিক্ষেত্রেও গড় আমদানি শুল্ক ৩৩% থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯%।

শেষে আর একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন— আরসিইপি-তে যোগ দিলে ভারতের রফতানির পরিমাণ কি কোনও ভাবে বাড়ত? ভারত কি রফতানির ভ্যালু চেনে খানিক হলেও উঠতে পারত? ভারত এই বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসা ইস্তক এই প্রসঙ্গে প্রচুর কথা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে আসিয়ান গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি, জাপান এবং কোরিয়ার সঙ্গে যে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা এফটিএ) আছে, সেগুলির দিকে খেয়াল করলেই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমবর্ধমান। তার মূল কারণ হল, ভারতের রফতানি তেমন ভাবে সে দেশের বাজারে বাড়তে পারেনি। ভারতের কৃষিক্ষেত্র বা নির্মাণশিল্প, কোনওটাই আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় লড়ার জন্য যথেষ্ট সক্ষম নয়। ভারতে বাণিজ্য সংস্কারের প্রক্রিয়াটি অনেক দিন ধরেই চলছে। বেশ কয়েক বার সরকার বদলেছে, কিন্তু কোনও সরকারই ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রের দক্ষতা ও কুশলতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হয়নি। আরসিইপি নিয়ে হইচই থেমে যাওয়ার পর সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে এই দিকটিতে মন দেওয়া। এমন ভাবে ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা, যাতে তা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে সক্ষম হয়, বাণিজ্যসঙ্গী দেশগুলির বাজারের দখল নিতে পারে।

যত দিন এই কাজটা ঠিক ভাবে না হচ্ছে, তত দিন অবধি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনায় ভারতকে রক্ষণশীল মানসিকতা নিয়েই এগোতে হবে।

সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

India RCEP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy