Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষার নীতি ও উদ্দেশ্য, প্রশ্ন থেকে যায়

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে বসলে বা বিজ্ঞজনেদের প্রশ্ন করলে, সাত কোটি জনের কাছে সাত কোটি উদ্দেশ্য মিলতে পারে। যার মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতাও থাকবে। তবুও পুরনো একটা ধারণা সকলের থাকে, সেটা হল জ্ঞান অর্জন। লিখলেন মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে বসলে বা বিজ্ঞজনেদের প্রশ্ন করলে, সাত কোটি জনের কাছে সাত কোটি উদ্দেশ্য মিলতে পারে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২০ ০১:২৮
Share: Save:

বছর কয়েক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাব্দী প্রাচীন ঘোষিত লক্ষ্য, যা ছিল ‘সত্যের অনুসন্ধান’ ও ‘মানব উন্নয়ন’, সেটিকে বদলানোর প্রস্তাব দেন এক কর্তৃপক্ষ। এ বার বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন লক্ষ্য হল ‘রাষ্ট্রের চাহিদা মেটানোর কর্মশক্তি নির্মাণ’। স্বভাবতই এ নিয়ে খুব হইচই পড়ে। শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে সর্বকালেই একটি উচ্চ আদর্শের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আদতে বিষয়টি কোন পথে যায়, তা নিয়ে আজ কিন্তু ভাবনা এবং দুশ্চিন্তার কারণ ঘটেছে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে বসলে বা বিজ্ঞজনেদের প্রশ্ন করলে, সাত কোটি জনের কাছে সাত কোটি উদ্দেশ্য মিলতে পারে। যার মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতাও থাকবে। তবুও পুরনো একটা ধারণা সকলের থাকে, সেটা হল জ্ঞান অর্জন। যে জ্ঞান মানুষের বেঁচে থাকার সহায়ক। আর এই জ্ঞান পাওয়া সমস্ত মানুষের অধিকার, যে অধিকারকে সুনিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।

কিন্তু জ্ঞানের চেহারাটা কী হবে আর কেমন করে তা ‘দেওয়া’ যাবে, কী পদ্ধতিতে, তা নিয়ে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা বরাবরই খুব চিন্তায় থাকেন। তাই থেকে থেকেই জাতীয় ও রাজ্যস্তরে শিক্ষানীতির বদল হয়। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গিয়েছেন— ‘‘শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যের সঙ্গে যদি আরো কোন অবান্তর উদ্দেশ্য ভিতরে ভিতরে থাকিয়া যায় তবে তাহাতে বিকার জন্মে।’’

সকলেই জানি, শিক্ষানীতি তৈরির ক্ষেত্রে ‘অবান্তর’ না হলেও আরও কিছু উদ্দেশ্য থেকেই যায়। কিছুকাল আগে ডক্টর কস্তুরী রঙ্গন কমিটির নয়া শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। এই কমিটির প্রস্তাবিত ‘ত্রি-ভাষা নীতি’ নিয়ে খানিক সমালোচনা হওয়ার পরে বিষয়টি অন্তরালে চলে গিয়েছে। শুধুমাত্র বিএড-এর ভবিষ্যৎ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়া এ নিয়ে যেন আর কারও ভাবার প্রয়োজন নেই। অথচ দেশের প্রতিটি নাগরিকের এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল।

এই কমিটির ঘোষিত উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তনশীল গতিময়তার সাথে খাপ খাওয়ানো এবং ভারতকে জ্ঞানের মহাশক্তি হিসেবে তুলে ধরা। এখানে বলা ভাল, তেমন কোনও শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি এই কমিটিতে ছিলেন না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের তরফেও কেউ প্রতিনিধিত্ব করেননি। ৪৮৪ পাতার এই প্রস্তাবে বহু বিষয় এসেছে। শিক্ষার অধিকার আইন, যা ইতিমধ্যেই দেশে কার্যকর, সেগুলির সম্প্রসারণ ঘটানোর কথা খসড়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে। ৬ থেকে ১৪ বছর নয়, তার ব্যাপ্তি ৩ থেকে ১৮ পর্যন্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। অর্থাৎ শিশুর নাগরিক হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণটুকুই রাষ্ট্রের হাতে আসছে।

এই বিষয়টি অনেকের কাছেই স্বাগত। কিন্তু, প্রশ্ন থেকে যায়, ৬ থেকে ১৪ বছরের পড়ুয়াদের শিক্ষারই যখন এই হাল, তখন সেই সমস্যার সমাধান না খুঁজে আরও একটি বড় অংশকে এর মধ্যে এনে তাদের শৈশবকে ভয়াবহ করা হবে না তো? বাড়িতে তার পরিবার ও সমাজ থেকে কোও ছেলেমেয়ে যেটুকু শেখে, সেটুকু থেকে সরিয়ে তাকে রাষ্ট্রের একমাত্রিক ছাঁচে ঢেলে ফেলা কি এখনই শুরু করা দরকার? ভাষা নিয়ে এখনও যে সমস্যা, ইংরেজির যে কর্তৃত্ব, তাতে শেষ পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিকে বেসরকারি বিদ্যালয়ের রমরমা হওয়ারই সম্ভাবনা। প্রাথমিকে এখনও বহু পড়ুয়ার প্রধান সমস্যা ভাষা, যা সে বাড়িতে শোনে, বলে, তা সে বিদ্যালয়ে পায় না, ফলে প্রথম থেকেই সে প্রান্তিক। প্রাক-প্রাথমিকে কি অন্য কিছু হবে?

ওই খসড়া শিক্ষানীতিতে শিক্ষাজীবনকে চার ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব হয়েছে। ৩ বছর থেকে ৮ বছর বা প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত, ৮ থেকে ১১ বা তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, ১১ থেকে ১৪ বা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি এবং শেষ ভাগে ১৪ থেকে ১৮ পর্যন্ত বয়সের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি। মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়তো থাকবে না। বড় পরীক্ষাটি হবে দ্বাদশের পরে।

এ সমস্ত কিছু মধ্যেই থাকবে সকলের অন্তর্ভুক্তি, যে চেষ্টা চলছে কতকাল থেকে। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ জমানায় সকলের জন্য শিক্ষার প্রস্তাবে সরকার বলেছিল এর খরচ তুলতে মদ বিক্রি করতে হবে। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী যার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। শিক্ষাখাতে বা স্বাস্থ্যখাতে এ দেশে কখনও অতখানি অর্থ বরাদ্দ হয় না, যা দিয়ে সকলের জন্য সার্থক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা যায়। বাজেটের সিংহভাগ যায় প্রতিরক্ষায়, দেশের মানচিত্র টিকিয়ে রাখতে। ভিতরের মানুষের জন্য খানিকটা কম পড়ে বৈকি!

এই শিক্ষানীতির ঝোঁক আছে আরও একটি দিকে, যা অবশ্যই আজ লেখাপড়া শেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়। শুরুতে যা বলা হল, অর্থাৎ রাষ্ট্রকে দক্ষ কর্মীর জোগান দেওয়া। অচিরেই ভারতের যুব-জনসংখ্যা ইউরোপের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি হবে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কালাম বলেছিলেন, এই বিপুল তরুণ প্রজন্ম যদি বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তাহলে গোটা দুনিয়াতেই তাদের ডাক পড়বে।

এই শিক্ষানীতিতে তাই হয়তো পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সহ-পাঠ্যক্রমকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। হাতের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির উপরে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরির দিকেই সাধারণের ঝোঁক বেশি। হাতের কাজ যারা করে থাকেন, তাঁদের বড় অংশই যথার্থ হাতেকলমে কাজ শিখেছেন। সার্টিফিকেট কোর্স করে নয়।

এই যে দক্ষতার কথা বলা হয়েছে, সেই দক্ষতা দিয়ে দুনিয়াকে তাক লাগিয়েছে চিন—তৈরি হয়েছে বিশেষ আর্থিক অঞ্চল বা এসইজ়েড, যেখানে উৎপাদনের অন্যতম উপাদান কম খরচায় দক্ষ শ্রমিক। প্রশ্ন উঠবে, এর সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার যোগ কতটুকু? বিশ্বজুড়ে বহুজাতিকদের লভ্যাংশ বাড়ানোর জন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরি করাই কি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য?

শিক্ষাকে কাজের সঙ্গে যুক্ত করা বা কর্মমুখী শিক্ষার ভাবনা গাঁধীজিরও ছিল। কিন্তু, তাঁর লক্ষ্য ছিল স্বনির্ভরতা। সেই স্বনির্ভরতার অর্থ কর্পোরেটের দাসত্ব করা নয়। ম্যানেজমেন্টের যে ডিগ্রির জন্য আজ মোটা টাকা ‘পণ’ দিতে হয়, সেটি বৃহত্তর সমাজের কোন কাজে আসে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে।

কস্তুরী রঙ্গন কমিটির প্রস্তাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ গিয়েছে। এই দেশের সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার ধর্মনিরপেক্ষতা। যে বোধ শিক্ষার আঙিনা থেকেই তৈরি হওয়া উচিত। সমতার কথা এলেও কিন্তু এ প্রসঙ্গটি আসেনি। ভারতের প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা এসেছে বারবার, পৃথিবীতে বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি পদ্ধতিতে প্রাচীন ভারতের অবদান নিয়ে অবশ্যই চর্চা হবে। কিন্তু তার পাশে থাকতে হবে বৈচিত্র্য এবং বহুস্বরকে ধারণ করার ভারতীয় মানস, যা আগামী দিনের পৃথিবীকে পথ দেখাতে পারে।

আজ গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার সার্থকতা এসে ঠেকেছে বোর্ড পরীক্ষায় সাফল্যের উপরে। জ্ঞান না তথ্য, কোনটা যাচাই হয় পরীক্ষায়— এ প্রশ্নও থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু চাকরির উপযুক্ত করবে না কি মানুষকে সেই বিচার শক্তি তৈরিতে সাহায্য করবে, যা দিয়ে সে ভাল-মন্দকে পৃথক করতে পারে। শিক্ষার কাজ ছিল, মানুষের মনের গ্রন্থিগুলি খুলে তার জানালা খুলে দেওয়া। বিশ্বের সঙ্গে যাতে সে যুক্ত হয়, কিন্তু তার পা দুটো শক্ত হয়ে দাঁড়ায় মাটির উপরে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনা থেকেই গেল। মহাজ্ঞানী মহাজন শিক্ষার উদ্দেশ্য বলে যা তুলে ধরেছেন, সেই মূল্যবোধকে শিক্ষায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর শিক্ষার্থী প্রণত হয়েও তার প্রশ্ন রাখবে।

লেখক স্কুল শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE