ক ত দ্রুত কতখানি পিছনে ছুটিয়া যাওয়া যায়, ভারতীয় সমাজে প্রতি দিন তাহার নূতন নূতন মাইল-ফলক তৈরি হইতেছে। একবিংশ শতক হইতে এক লাফে অষ্টাদশ শতক, কিংবা হয়তো তাহারও আগে, যে এত কম সময়ের মধ্যে অবতীর্ণ হওয়া যায়, কিছু কাল আগেও ভাবা যাইত না। ভারতীয় মানসে বর্ণবিদ্বেষ একটি প্রধান আবেগ হিসাবে উপস্থিত। গায়ের রং দিয়া এ দেশে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ হয়, এমনকী ভালমন্দ বিচারও হয়, সবই জানা। বহু কালের জাতিভেদ-অধ্যুষিত সমাজ ভিতরের বিদ্বেষ ভাবটিকে বাহিরে প্রবল ভাবে প্রকাশ করিতেও শিখাইয়া দিয়াছে, সে কথাও অজানা নয়। তবু এ সবের পরও আশ্চর্য হইবার অবকাশ ফুরায় না: গায়ের রং কালো বলিয়া কোনও মানুষকে নরখাদক হিসাবে প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা— ইহা আধুনিক বিশ্বের আরও নানা দেশে দেখা যাইবে কি? বিশ্বের কোনও প্রত্যন্ত কোণে কেউ এমন ভাবিতেছে, এই যুক্তি দিলে চলিবে না। গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের খাস রাজধানীতেই এখন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় আফ্রিকার ছাত্রদের বাড়িতে হামলা করিয়া নরখাদকের সুমারি হইতেছে, খবর ইহাই। পিছন দিকে হাঁটিবার জন্য এখন দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা লাগিয়া গেলেও এক লাফে সর্বাধিক সময়-দূরত্ব অতিক্রম করিবার খেলাটিতে ভারতই স্বর্ণপদক দাবি করিবে।
অনেকেই বলিতেছেন, দেশের মাটিতে বিদেশিদের উপর এই অকথ্য নির্যাতনে দেশের মাথা হেঁট হইল। আফ্রিকার সঙ্গে কী ভাবে অতঃপর সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হইবে। বলিতেছেন, ইহার পর আফ্রিকার মানুষ কী ভাবে ভারতে আসিয়া পড়াশোনা করিেবন, কিংবা বেড়াইতে আসিবেন। বলিতেছেন, ভারত-আফ্রিকা বৃহত্তর যোগাযোগের বিপুল ক্ষতিতে মাঝখান হইতে বিপুল লাভবান হইয়া বসিবে চিন।
এ সব কথাই সঙ্গত। কিন্তু উদ্বেগটি এই সবের অপেক্ষা অনেক বড়। এই নাইজিরীয় যুবকরা ‘বিদেশি’, ইহা কেবল একটি আপতিক ঘটনা। দেশের মাথা হেঁট হইবার কথাই যদি ওঠে, তবে কোনও মানুষের সঙ্গেই যে এত নিকৃষ্ট ব্যবহার করা যায়, এই সংবাদটুকুই চক্ষু-উন্মীলক। সকলে জানুক, ভিতরে গণতন্ত্রের বড়াই, বাহিরে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদের তীব্র দাবি, আর বিজ্ঞাপনে ‘অতিথি দেবো ভব’ সুভাষিত লইয়া ভারত নামক দেশটি কী অপার আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে দিনযাপন করে! উন্মত্ত জনতা আসিয়া যে ছেলেগুলির ফ্রিজ পরীক্ষা করিয়া দেখিল তাহাতে মানুষের মাংস আছে কি না, তাহারা নাইজিরীয় না হইয়া ব্রাজিলীয় কিংবা অরুণাচলীয় হইলে ভারত বিষয়ে আন্তর্জাতিক বক্তব্য বিশেষ পাল্টাইত কি? মনে হয় না।
অর্থাৎ ইহা শুধু বর্ণবিদ্বেষ বা জাতিবিদ্বেষের বিষয় নয়, মানববিদ্বেষের বিষয়। কী অভাবনীয় অসহিষ্ণু অ-সভ্যতায় গ্রস্ত হইয়াছে ভারতীয় সমাজ, বিশ্বময় তাহা ব্যক্ত হউক। বাহবা, নরেন্দ্র মোদীর দেশ! অসহিষ্ণুতাকে দুধকলা দিয়া প্রশ্রয় দিয়া চলিলে কত বিচিত্র ভাবে তাহা সমাজের প্রতি স্তরে বিষ ছিটকাইতে শুরু করে, তিন বৎসরের মধ্যে এই দেশকে তাহার কেস-স্টাডি-তে পরিণত করিবার জন্য মোদীরই জয়গান প্রাপ্য। তিনি নাকি আফ্রিকার সহিত বন্ধুত্ব করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন। অথচ এখনও অবধি দেশের এত বড় কলঙ্কে দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি কথা বলিবার সুযোগ খুঁজিয়া পান নাই। হয়তো ধর্মগুরু সন্নিবেশে রাজনীতি সাধনায় ব্যস্ত আছেন বলিয়া। অথচ শিক্ষা-অল্পশিক্ষা নির্বিশেষে সংস্কার-নিমজ্জিত সমাজ যদি এক গোত্রের মানুষের উপর মনুষ্যখাদক তকমা চাপাইয়া বহিষ্কার বা প্রাণে মারিবার উপক্রম করেন, তবে প্রশাসনকেই শেষ অবধি দায়িত্ব লইতে হইবে, শাস্তির ভয় দেখাইয়া কুসংস্কারকে সিধা করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy