Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রাজনৈতিক পূজা

বিশেষত প্রেক্ষিতটি যখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। কোনটি যে রাজনৈতিক প্রচার এবং কোনটি অ-রাজনৈতিক, তাহা বুঝা এখন দুঃসাধ্য।

গোপালের মূর্তির পাশে আর নেই মোদী-ইমরান।

গোপালের মূর্তির পাশে আর নেই মোদী-ইমরান।

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ভারতীয় তথা বঙ্গীয় রাজনীতি তাহার পরিচিত খোলস ত্যাগ করিয়াছে। প্রবেশ করিয়াছে সমাজের অন্দরে, সাধারণের দৈনন্দিনতায়। রেহাই নাই পূজার মঞ্চেরও। যেমন, উত্তর কলিকাতায় দোল পূর্ণিমায় গোপাল পূজার ‘থিম’ পুলওয়ামা কাণ্ড এবং পাক সেনার হাত হইতে সদ্যমুক্ত বায়ুসেনা অফিসার অভিনন্দন বর্তমানের মূর্তি। বস্তুত অভিনন্দন মুক্ত হইবার সময় থেকেই সমাজমাধ্যমে রসিকতা চলিতেছিল, কত দ্রুত তিনি ‘থিম’রূপে আবির্ভূত হইবেন। সুতরাং, এমন চমকদার থিমও আগাম প্রত্যাশার জোয়ারে খানিক ম্লান। কিন্তু থিম ঘিরিয়া সন্দেহ দানা বাঁধিয়াছে। সন্দেহের কারণ, অভিনন্দনের এক দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অন্য দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মূর্তি। উপরের ফ্লেক্সের লেখা পড়িলে বোধ হয়, মোদীর হুঙ্কারেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দনকে ফেরত পাঠাইয়াছেন। লেখাটির সঙ্গে বালাকোট-উত্তর বিজেপির প্রচারের আশ্চর্য মিল! শেষ পর্যন্ত মূর্তি দুইটি সরাইয়া লওয়া হইলেও সম্পূর্ণ থিমটিকে নিতান্ত নির্দোষ ভাবা ঈষৎ কঠিন।

বিশেষত প্রেক্ষিতটি যখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। কোনটি যে রাজনৈতিক প্রচার এবং কোনটি অ-রাজনৈতিক, তাহা বুঝা এখন দুঃসাধ্য। ২০১৪-উত্তর ভারতে নির্ভেজাল রাজনৈতিক স্লোগানগুলিকে এমন সুকৌশলে সমাজের মধ্যে পুরিয়া দেওয়া হইয়াছে, যে তাহাকে প্রায়শই অ-রাজনৈতিক কণ্ঠ বলিয়া ভুল হয়। রাজনৈতিক নেতা জনসভায় কিংবা নির্বাচনী প্রচারে সার্জিকাল স্ট্রাইকের প্রসঙ্গ টানিয়া নিজ দলের কৃতিত্বটি তুলিয়া ধরিলে, তাঁহার দলীয় রংটি চিনিয়া লওয়া সহজ। তাঁহাকে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করাও সহজ। যেমন, সামরিক বাহিনী এবং অভিনন্দনকে লইয়া বিজেপির রাজনৈতিক প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিয়াছে নির্বাচন কমিশন। অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছে সামরিক বাহিনীও। কিন্তু সম্পূর্ণ অ-রাজনৈতিক আমজনতার কথোপকথনে, মতাদর্শে, আচরণে, এমনকি ননিচোরার পূজাতেও এক বিশেষ দলের রং লাগিলে, রুখিবে কে?

অবস্থা শোচনীয়। এতটাই যে, জেএনইউ-এর উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সাঁজোয়া গাড়ি রাখিবার প্রস্তাব দেন, দেশের চল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একযোগে ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পক্ষে সায় দেন, এয়ার ইন্ডিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সংবলিত বোর্ডিং পাস বিতরণ করে। রাজনীতির সামাজিকীকরণ ঘটিলে নিতান্ত অ-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিত্বও রাজনীতির সুরে কথা বলিতে থাকে। সামাজিকীকরণের এই প্রক্রিয়ায় সমাজমাধ্যমের অবদান অনস্বীকার্য। অত্যন্ত কার্যকরও। নেতার বক্তৃতার মেয়াদকাল কিছু ঘণ্টা। শ্রোতার সংখ্যাও সীমাবদ্ধ। সভা ফুরাইলে রেশ মিলাইতে কত ক্ষণ! কিন্তু সমাজমাধ্যম মারফত দলীয় বক্তব্যটি অনায়াসেই এক বিশাল সংখ্যক জনতার হেঁশেল অবধি পৌঁছাইতে পারে, তাঁহাদের জীবনযাপনে মিশিয়া যাইতে পারে, এবং স্বাধীন চিন্তার ধারাটিকে গ্রাস করিতে পারে। সেই সর্বগ্রাসী প্রচারের রং আলাদা করিয়া চিনিয়া লওয়া অত্যন্ত কঠিন। শ্রীকৃষ্ণ মূলত রাজনীতিক ছিলেন কি না, তাহা লইয়া গভীর তর্ক চলিতে পারে, কিন্তু বালগোপালকে লইয়া রাজনীতি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE