উনিশশো তেত্রিশ সালে মহাত্মা গাঁধী তাঁহার অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করিয়া সমগ্র দেশ পরিভ্রমণ করিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন। মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধার মতো দেশের একেবারে কেন্দ্রবিন্দু হইতে শুরু করিয়া উত্তরে পঞ্জাব এবং দক্ষিণে কেরল পর্যন্ত আন্দোলন ছড়াইবার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁহার। মহাযাত্রার প্রথম কাজ হিসাবে তিনি বাছিয়াছিলেন, ওয়ার্ধার একটি মন্দির নিম্নবর্ণের সকল মানুষের জন্য খুলিয়া দেওয়া। ঘটনাচক্রে তাঁহার অনুগত যমুনালাল বাজাজের স্বভূমিও ওয়ার্ধা, এবং বাজাজ ইতিমধ্যেই সেখানে তাঁহার পরিবারের মন্দিরটি বর্ণনির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। বিনোবা ভাবে-র কর্মযজ্ঞও শুরু হইল সেই মন্দির-উন্মোচনকারী আন্দোলন হইতেই। এই ভাবেই ক্রমে নিকট ও দূর বলয়ে ছড়াইয়া প়ড়িবে তাঁহাদের কাজের প্রভাব, এমনই হয়তো ভাবিতেছিলেন মহাত্মা ও তাঁহার সঙ্গীরা। সৌভাগ্য তাঁহাদের, একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ ভাগে আসিয়া তাঁহাদের দেখিতে হয় নাই যে কেরলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ, তথাকথিত প্রাগ্রসর প্রদেশের মন্দিরে যাহাতে নারীরা প্রবেশ করিতে পারেন, সেই মর্মে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রায় প্রদান করিতে হইল। শবরীমালা মন্দির-কাণ্ডটি গাঁধীর সার্ধশতজয়ন্তীতে স্মরণ করিবার একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। ভারতীয় সমাজ কেবল বর্ণাশ্রিত অস্পৃশ্যতাতেই বিশ্বাস করে না, বিবিধ কারণে বিভিন্ন গোত্রের মানুষকে অস্পৃশ্য করিয়া রাখিবার বন্দোবস্ত এখানে দশকের পর দশক ধরিয়া কায়েম রহিয়াছে। মহাত্মা যদি দেখিতেন, কেবল ঋতুমতী হইবার অপরাধে স্বাধীন দেশে বৃহত্তর হিন্দু সমাজ কৈশোর হইতে প্রৌঢ়ত্ব অবধি নারীদের অস্পৃশ্য রাখিবার ব্যবস্থা করিয়াছে, নিজের দেড়শতবর্ষ উদ্যাপনের রাষ্ট্রিক হুড়াহুড়িও তাঁহাকে বিন্দুমাত্র সুখী করিতে পারিত না।
সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার রায় দিতে গিয়া এই কারণেই মাননীয় বিচারপতিরা ইহাকে নূতন ভারতের অস্পৃশ্যতা কর্মসূচি বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। দেশের সংবিধানের গোড়ার অনুচ্ছেদে বলা আছে যে এ দেশে ধর্মবর্ণজাতলিঙ্গের উপর ভিত্তি করিয়া কোনও রকম বৈষম্য করা চলিবে না। অথচ এখনও সমাজের অর্ধাংশকে অচ্ছুৎ করিবার সিদ্ধান্ত যে কত ব্যাপক জনসমর্থন পাইতে পারে— শবরীমালার দৃষ্টান্ত তাহার প্রমাণ। পুরুষতন্ত্রের এই গভীরপ্রোথিত চর্চায় একই উদগ্রীবতায় শামিল মহিলারাও— কেরলে সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনিয়া যাঁহারা ধর্মের উপর রাষ্ট্রের এ হেন ‘আক্রমণ’-এ বিক্ষুব্ধ ও বিপন্ন বোধ করিতেছেন, তাঁহাদের মধ্যে আছেন বহু মহিলা।
ইহাও লক্ষণীয়, সর্বোচ্চ আদালতের যে বিচারপতিরা এই মামলার রায় দিলেন, তাঁহাদের মধ্যে এক জনই রায়ের বিরুদ্ধতা করিলেন, এবং তিনি নারী। মাননীয় বিচারপতি ইন্দু মলহোত্রের মতে ধর্মের মতো ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের পদচিহ্ন বাঞ্ছনীয় নয়। কোনও দেবতাকে মানিবার অধিকার ও তাঁহার মন্দিরের ধর্মাচরণের বিচার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, বলিয়াছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁহার অবস্থান লইয়া অনেক আলোচনা হইতেছে: কেন তিনি নারী হইয়া নারী-অধিকারের বিরুদ্ধতা করিতেছেন। কিন্তু মলহোত্রের যুক্তিটির গুরুত্ব কোনও মতেই ছোট করিয়া দেখিবার মতো নহে। তবে মন্দিরের পূজার্চনায় কতটা ব্যক্তিপরিসর আর কতটা সামাজিক পরিসর, সেই বিতর্ক রহিলই। শুধু এই মন্দিরে প্রবেশ প্রসঙ্গে নহে, ঋতুমতী মহিলাকে অস্পৃশ্য করিয়া রাখা ধর্মের খাতিরেও গ্রাহ্য কি না, প্রশ্ন সেখানেও। মহাত্মার লড়াই সহজসাধ্য হইবার নহে। ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিসরে ব্রাত্য ও প্রান্তিক করিয়া রাখিবার প্রবণতাটি এত বহুমুখী যে লড়াই সহজে শেষ হইবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy