Advertisement
E-Paper

শহরের মধ্যে আরও কত শহর

খেয়াল করে দেখেছি স্থানমাহাত্ম্য ও সঙ্গমাহাত্ম্য সেলফি তোলার প্রধান কারণ। দামি হলে সিনেমা দেখতে গেলে, চকচকে জায়গায় খেতে গেলে, দুর্গম দূর নিসর্গে প্রবেশ করলে, ঐতিহাসিক স্থানে পদার্পণ করলে সেলফিবাসনার জিভ লকলক করে ওঠে।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৬

আনন্দে সব বাধা টুটে/সবার সাথে ওঠ্‌ রে ফুটে,/ চোখের পরে আলস-ভরে/ রাখিস নে আর আঁচল টানি: (‘শারদোৎসব’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। আত্মরতিপরায়ণ বাঙালি দিন দিন মোবাইলমোহন হয়ে উঠছেন। শুধু বাঙালির কথাই বা বলি কেন, মোবাইলে আত্মপ্রতিকৃতি ধরে রাখার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তা পোস্ট করার এই কালান্তক সেলফিম্যানিয়া তো এখন সর্বভারতীয়। খেয়াল করে দেখেছি স্থানমাহাত্ম্য ও সঙ্গমাহাত্ম্য সেলফি তোলার প্রধান কারণ। দামি হলে সিনেমা দেখতে গেলে, চকচকে জায়গায় খেতে গেলে, দুর্গম দূর নিসর্গে প্রবেশ করলে, ঐতিহাসিক স্থানে পদার্পণ করলে সেলফিবাসনার জিভ লকলক করে ওঠে। আমাকে দেখুন! কেউ কেউ অবশ্য এমনি এমনি সেলফি তোলেন। ‘আয়না আয়না জগতে সব চেয়ে সুন্দর কে’ এই ছদ্মজিজ্ঞাসায় ভোগেন। আত্মরতি যত প্রবল হয়, চোখ তত বন্ধ হয়ে যায়। কিছুই দেখতে চাইছি না, কিছুই বুঝতে চাইছি না। এই ভীষণ সামাজিক ব্যাধি মানুষকে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে, স্বার্থপরতার অলীক স্বর্গে নির্বাসিত করে। মানুষ ভাবতে শুরু করে সে যেটুকু নিজেকে ঘিরে দেখছে ও দেখাচ্ছে, সেটুকুই শেষ সত্য।

এই দুঃসময়ে শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই পঙ্‌ক্তিগুলি থেকে থেকেই মনে পড়ে। ‘‘শুনুন যাঁরা মস্ত পরিত্রাতা/ এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা/ হেঁটে দেখতে শিখুন’’। দেখতে চাইলে কিন্তু নিজের দিক থেকে চোখ সরাতে হবে বাইরে। সেই কাজটাই করেছে ‘ঘুরে দ্যাখো কোলকাতা’ (একলব্য) বইটি। নভেম্বর ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ছবি-তুলিয়ে কৌশিক আকীর ওয়ানপ্লাস এক্স ক্যামেরা আর আইফোন এসই কলকাতার ভেতরের অন্য কলকাতাকে ঘুরে ঘুরে দেখেছে, ধরে রেখেছে। সেই দেখার ছবি সঙ্কলন করে দিয়েছেন মাস্টারমশাই অম্লান দাশগুপ্ত। কী দেখেছে সে? নিজেকে নয়, দেখেছে কলকাতাকে। অন্য মানুষের কলকাতা। সেখানে রয়েছে সাধারণ মানুষের শ্রম আর আলস্যের ছবি, গমনের ও বিরামের দৃশ্য। তাঁরা আমাকে দেখুন বলে থমকে থাকার বিলাসে আটকে পড়ার অর্থ ও সুযোগ পান না। যে মানুষ ও বস্তু এই সব ছবি-দৃশ্যের বিষয় তা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত অনুষঙ্গেই সুদৃঢ়। কোথাও কোথাও উচ্চবিত্তের উপাদান এসেছে বটে, তবে তলার মানুষ-পৃথিবী সেই উপাদানটিকে নিজেদের ঘামে-শ্রমে-বিরামে একান্ত করে নিয়েছেন। এই সঙ্কলনে রাস্তার ওপরে দাঁড় করানো একটা দামি গাড়ির ছবি দেখে বড় আরাম হল। ভাঙা-রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাড়িটির উপর জামা-প্যান্ট, ন্যাকড়ার ফালি শুকোতে দেওয়া হয়েছে! অসামঞ্জস্যকে ঈর্ষা দিয়ে শুধু দূরে ঠেলে রাখে না এই শহর, অসামঞ্জস্যকে বিচিত্র-প্রয়োগে নিজের দিন-আনি-দিন-খাইতে সুসমঞ্জস করে নেয়। ওই দামি গাড়ি কলকাতার গলিতে আর বেমানান রইল না, জামাকাপড় শুকোতে দেওয়ার একান্ত ভরসাময় শরীরে হয়ে উঠল সে অযান্ত্রিক। ব্যক্তিগত বিত্তকে এ ভাবে সামাজিক করে নিতে না পারলে এ শহর কিন্তু এমন করে বেঁচে থাকতে পারত না। সব চেয়ে বড় কথা, যাঁদের বিত্তে সামাজিক ব্যবহারের হাত পড়ে, তাঁরাও অধিকাংশই একদা, এখনও পর্যন্ত এই সব মেনে নেন। সে দিন পর্যন্তও তো কলোনি পাড়ায় ফ্রিজ থাকত হাতে-গোনা বাড়িতে। গরমে বরফ জল খেতে তাতে পাড়ার লোকদের অসুবিধে হত না।

এ শহরে সাধারণের পথচলতি বিরামদৃশ্যগুলি অনেক কিছু বলে। নামী কুকিজ় আর দামি কেকের পাশে লোকাল ছোটখাটো বেকারির জিনিসপত্রবাহী ঢাকা বাক্স-রিকশাগুলি এখনও এখানে চলে। বাক্স-রিকশায় টিফিন কেক, খাস্তা বিস্কুট, লাড্ডু নিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে যান কত হাফপ্যান্ট আর ফ্রকের রূপকথার মানুষ! এমনই দু’জন ধরা পড়েছেন একটি ছবিতে। দু’জনে মুখোমুখি, চুপ করে দাঁড়িয়ে। ঘামে ভেজা ফতুয়া গায়েই শুকিয়েছে। অন্য ছবিতে নামি কোম্পানির আইসক্রিমের ফলকের উল্টো দিকে দু’টি নীরব চায়ের গ্লাস, কালো চা। যাঁদের আর তেমন ডাক পড়ে না সেই গড়ের মাঠের বাদ্যওয়ালা, ব্যান্ডপার্টির শিল্পীরা এখনও আছেন এ শহরে। বন্ধ দোকানের নামানো শাটারের সামনে বসে মুড়ি খাচ্ছেন দু’জন— আর এক ছবির বিষয়।

এই সব শ্রমবিরতি, নীরবতা যে কলকাতাকে শুধু ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত করে, তা কিন্তু নয়। রাস্তাই তাঁদের একমাত্র রাস্তা, এই সারসত্য জানেন বলেই পথেই তাঁদের নিদ্রা, ক্রীড়া-কৌতুক, সংলাপ। ঠেলা গাড়িতে শরীর রেখে ফুটপাতের লোহার রেলিংকে পাশবালিশ করে ঘুমোচ্ছেন তিনি। প্যাকিংবাক্সই তো মালবাহকটির বালিশ। ইস্ত্রির বাক্স-দোকান আপাতত বন্ধ। খুকুটি উবু হয়ে সে বন্ধদোকানের বাক্সে ঈষৎ হাসি মুখে বসে আছে। গাড়িতে চেপেছে বুঝি! সওয়ার বাবুদের দেখা নেই যখন তখন রিকশার পাদানিতে বসেই পড়ে ফেলা যাক দৈনিক বাংলা কাগজ। চললে এ রিকশা, না চললে রিকশাওয়ালার বৈঠকখানা। তাস পেটানো চলছে। বাজার দুপুরবেলা বন্ধ থাকে। পাথরের ওপর বসে ইশকাপনের নওলা ফেলছেন যিনি, তিনি ভাবছেন এই তো স্বর্গ। তাসের পাশাপাশি গলিতে দাবাও চলে ভাল। দাবা মধ্যবিত্তদের সঙ্গী। পাড়ার বৃদ্ধেরা বোর্ড বিছিয়েছেন। গোলকায়নের অনেক আগের মানুষ তাঁরা, কলোনি যুগের। দেশভাগের পর গড়ে ওঠা কলোনির এক এক দিকের জমি-বাড়ির এখন অনেক মূল্য, আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়ি। এই দাবাড়ুর দলে এক জন মাঝবয়সি ঢুকে পড়েছেন। হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন, চোখ পুরনো দাবায়। ওই যে বীরদর্পে বাচ্চা মেয়েটি স্টিলের লম্বাটে কৌটোয় চা ও অন্য হাতে ভাঁড় নিয়ে চলেছে, ওই যে আলুর দোকানে বসা মায়ের ঘেমো ব্লাউজে ভরসার হাত রেখেছে ছেলে, ওই যে রাস্তায় বসে সাবানজলে বাসন, জামাকাপড় পরিষ্কারের ফাঁকে প্রৌঢ়া কথা বলে নিচ্ছেন তাঁর পরিচিতার সঙ্গে, এঁদের জীবনীশক্তি অন্য কলকাতাকে, পায়ে দেখার কলকাতাকে এমন করে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ভয় হয় গোলকায়নের দাপটে গরিবি-হটানোর ভঙ্গিতে এই অন্য-কলকাতার বিচিত্র বহুমুখী পরিসর রাষ্ট্র ও পুঁজি মুছে ফেলবে না তো! কলকাতার জীবনীশক্তিতে আর রাস্তার জীবনধর্মে ভরসা রাখা ছাড়া উপায় নেই। আত্মরতিপরায়ণ মুখঢাকা আমাকে-তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে শরৎকাল নিজের থেকে বাইরে এসে দাঁড়ানোর ঋতু। রবিঠাকুরের সেই ‘শারদোৎসব’ নাটকের কথা মনে নেই! সেখানে শরৎকালে সবাই পথে নেমেছিল, আমরাও একটু পথে নামি। ঘুরে দেখি কলকাতার মধ্যে থাকা অনেক কলকাতা।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

Disease Selfie
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy