Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সব আঠারো সমান

আদালতের রায়টির আরও একটি গুরুত্ব: নাবালিকা বিবাহ রুখিবার আইনি অস্ত্রটিকে ইহা আরও মজবুত করিবার পথ প্রস্তুত করিল।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস এখন হইতে ধর্ষণ বলিয়া গণ্য হইবে: দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায়। ঐতিহাসিক, কেননা, এ যাবৎ কাল ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞায় যে ছিদ্রটি বিরাজ করিতেছিল, তাহাকে এই নূতন রায় বুজাইয়া দিল। ওই ধারা অনুযায়ী, সম্মতিরহিত বলপূর্বক যৌনসম্পর্ক স্থাপনই ধর্ষণ, এবং সম্মতির বয়সটি মেয়েদের ক্ষেত্রে আঠারো। ভারতীয় আইনে মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তির সীমাও আঠারো। অর্থাৎ, আঠারো বৎসরের কমবয়সি কোনও মেয়ে, যে আইনের চোখে নাবালিকা, তাহার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করিলেই পুরুষটিকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত করা যাইত, কেননা নাবালিকার সম্মতি অপ্রাসঙ্গিক অথবা মূল্যবিহীন। কিন্তু এই আইনে একটি ছাড় রাখা হইয়াছিল। ছাড়টি ছিল বিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে। বিবাহিত পুরুষের স্ত্রী যদি অপ্রাপ্তবয়স্কও হয়, অর্থাৎ আঠারোর নিম্নে হয় কিন্তু পনেরো বৎসরের ঊর্ধ্বে হয়, তবে সেই সহবাস ধর্ষণের আওতায় পড়িত না। অর্থাৎ, নাবালিকার সহিত যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপরাধী এবং নিরপরাধের মধ্যে এক বিভাজন রেখার কাজ করিত বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি। সাম্প্রতিক রায়ে সর্বোচ্চ আদালত এই বিভেদটি মুছিয়া দিল। বিবাহিত হউক বা না হউক, আঠারো বৎসরের কমবয়সি যে কোনও মেয়ের সম্মতির দাম দাঁড়াইল সমান।

আদালতের রায়টির আরও একটি গুরুত্ব: নাবালিকা বিবাহ রুখিবার আইনি অস্ত্রটিকে ইহা আরও মজবুত করিবার পথ প্রস্তুত করিল। অনেক ঢাকঢোল বাজাইয়াও দেশে নাবালিকা বিবাহ রোখা যায় নাই, উপরন্তু নাবালিকার স্বামীকে ‘ধর্ষক’ হইবার হাত হইতে আইনি রেহাই দিয়া বাল্যবিবাহের প্রতি কিছু নরম মনোভাবই প্রদর্শিত হইয়া আসিতেছিল। ফলে, আইন এবং বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফাঁক ছিল। বয়ঃপ্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়া দেশের আইনে মেয়েদের বিবাহের বয়স আঠারোই ধার্য। বাস্তব কিন্তু বলিতেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তো বটেই, শহরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যেও নাবালিকা বিবাহের দিব্য প্রচলন। মেয়ে রজঃস্বলা হইবার সঙ্গে সঙ্গেই সে কাহারও স্ত্রী এবং বছর না পুরিতেই কাহারও মা হইয়া যায়। এই নূতন সম্পর্কের গুরুভার বহনের পক্ষে তাহার শরীর ও মন যে উপযুক্ত নহে, বিজ্ঞানের সেই হুঁশিয়ারি কার্যত ধোপে টিকে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রসূতি না পারে নিজের যত্ন লইতে, না পারে সন্তানের দেখভাল করিতে। ফলত, উভয়েই অপুষ্টিতে ভুগে। দেশে প্রসূতিমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর উচ্চহারের জন্য বাল্যবিবাহ অনেকাংশে দায়ী। আদালতের রায়টি তাই এই অমানবিকতা রদেরও আশা জাগায়।

সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রশ্নও রাখিয়া যায়। নাবালিকা বিবাহের মতো এত বড় সামাজিক সমস্যাকে কি আইনের রক্তচক্ষু দিয়াই নির্মূল করা সম্ভব? যে গভীর আর্থ-সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া কন্যার পিতামাতা বা দরিদ্র পরিবার দ্রুত কিশোরীটিকে সুপাত্রস্থ করিতে চায়, এক জনের খাবার বাঁচায়, মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার সুকঠিন দায়িত্ব হইতে নিষ্কৃতি পায়, শুধুমাত্র আইন দিয়া কি তাহার মোকাবিলা সম্ভব? ইহাও ঠিক যে, আইন তখনই সহায়ক হইবে, যখন একটি অভিযোগ জমা পড়িবে। কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ বলিয়া কোনও বস্তু যে দেশে এতই অশ্রুত ও অগুরুত্বপূর্ণ, সেখানে নাবালিকা বধূ নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনিয়া নিরাশ্রয় হইবার ঝুঁকি লইবে কি? উত্তর খোঁজা জরুরি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়টির গুরুত্ব অনস্বীকার্য, কিন্তু পরবর্তী ধাপগুলি লইয়া আরও ভাবনা ও সচেতনতা বিস্তারের প্রয়োজন। অন্তত এই দায়টুকু কি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা লইবেন? সকল যুগান্তকারী রায়ের জন্য আদালতের মুখাপেক্ষী না হইয়া কিছু দায় কি তাঁহারা পালন করিবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sexual intercourse Minor Marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE