Advertisement
E-Paper

‘ওরে মন, হবেই হবে’

বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত। পাকিস্তান আমলে তাঁকে প্রায়শই কারাগারে অন্তরিন থাকতে হত।

প্রতিবেশী: শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি, ২০১৭

প্রতিবেশী: শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি, ২০১৭

শেখ হাসিনা

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৮ ০০:৪৯
Share
Save

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,/ তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার/ বারম্বার

শান্তিনিকেতন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে গড়া এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান আমাদের যেমন মাতৃভাষা বাংলা চর্চার সুযোগ করে দেয়, তেমনি বিশ্বসাহিত্যকে জানার দুয়ার খুলে দেয়। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গেই তিনি জড়িয়ে আছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন হতে চলেছে, এটা কত যে আনন্দের এবং গৌরবের, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। শান্তিনিকেতনে এই ভবন স্থাপনের সুযোগ প্রদানের জন্য আমি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার, ভারত সরকার এবং সর্বোপরি ভারতের বন্ধুপ্রতিম জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি আনন্দিত এ জন্য যে, ভবনটি প্রতিষ্ঠায় যৎসামান্য হলেও আমার সম্পৃক্ততা থাকল।

বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত। পাকিস্তান আমলে তাঁকে প্রায়শই কারাগারে অন্তরিন থাকতে হত। তাঁকে রাখা হত নির্জন কক্ষে। কারাবাসের এই নিঃসঙ্গ দিনগুলিতে তাঁর একমাত্র সঙ্গী থাকত বই। তিনি যে সব বই সঙ্গে নিতেন তার মধ্যে অবশ্যই রবীন্দ্র রচনাবলি থাকত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করে রেখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখা আব্বার মুখস্ত ছিল। তিনি বাড়িতে এবং স্টিমারে টুঙ্গিপাড়ায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন। আব্বার কয়েকটা প্রিয় পঙ্‌ক্তি ছিল: উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,ভয় নাই ওরে ভয় নাই—/ নিঃশেষে প্রাণ যে কবিরে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।

অনেকটা বাড়ির পরিবেশের কারণে আর খানিকটা বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ায় আমি নিজেও সারা জীবন রবীন্দ্রাচ্ছন্ন রইলাম। একটা সময় ছিল, প্রচুর বই পড়তাম। অবশ্যই কবিগুরুর বই তাতে প্রাধান্য পেয়েছে। এখনও সময় পেলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ি, তাঁর গান শুনি। রবীন্দ্র-সাহিত্য সকল দুঃখ-বেদনা-ক্লেশ দূর করে হৃদয়ে এক অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের ১৮ জন সদস্য সহ হত্যা করা হয়। আমরা দু’বোন সে সময় জার্মানিতে ছিলাম। আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দেওয়া হয়। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধী আমাদের ভারতে নিয়ে আসেন ও আশ্রয় দেন। সে এক কঠিন সময় গিয়েছে আমাদের। দেশের মাটিতে পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। বাবা-মা-ভাইয়ের কবর দেখব সে সুযোগও নেই আমার তখন। সেই দুঃসময়ে ভারত সরকার ও এ দেশের জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্তে সে কথা স্মরণ করি। স্মরণ করি ’৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অপরিসীম আত্মত্যাগের কথা। সে কথা বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভুলবে না।

বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে কিছু সমস্যা বিদ্যমান। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এ ধরনের সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। ভাইয়ে-ভাইয়ে যেমন সমস্যা থাকে। কিন্তু আন্তরিকতা থাকলে সে সব সমস্যা মেটানো যে সম্ভব তা আমরা বার বার প্রমাণ করেছি। আমরা ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি-বণ্টন চুক্তি সম্পাদন করি। ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ভারতের পার্লামেন্টের সকল সদস্যের সমর্থনে স্থল সীমানা বিলটি পাশ হয়। আমি সকলের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে এক বিরল দৃষ্টান্ত আমরা দুই দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। এত উৎসবমুখর পরিবেশে এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে বিশ্বের কোথাও এ ভাবে ছিটমহল বিনিময় হয়নি।

বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে জন-যোগাযোগ বেড়েছে। সরাসরি রেল ও বাস চলছে দু’দেশের মধ্যে। নদীপথে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা আরও বাড়াতে হবে। কারণ, আমাদের উভয় দেশেরই লক্ষ্য অভিন্ন। আর তা হল, সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন।

বাংলাদেশে আমরা জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। এক দশক আগের বাংলাদেশ এবং এখনকার বাংলাদেশ এক নয়। বর্তমান বাংলাদেশ অনেক আত্মপ্রত্যয়ী, পারঙ্গম, সাহসী বাংলাদেশ। আমরা নিজ অর্থপ্রদানে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ সেতু নির্মাণ করেছি। মহাকাশে আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। গত মার্চে বাংলাদেশ সব ক’টি শর্ত পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। লিঙ্গবৈষম্য কমানো ও নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ।

আজকের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর সম্পর্কে জানতে হলে গ্রামাঞ্চলে যেতে হবে। সেখানে কুঁড়েঘর পাওয়া খানিকটা দুষ্করই হবে এখন। প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলের গ্রামগুলোও পাকা রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত। ৯০ শতাংশ বাড়িঘর বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। প্রতি ছ’হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, যেখান থেকে বিনা পয়সায় ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। চাষাবাদে লেগেছে আধুনিক যন্ত্রের ছোঁয়া।

আমরা, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সহ ভারতের এক বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাদের সংস্কৃতি, জীবনধারা এক। আন্তর্জাতিক সীমানা আমাদের বিভাজিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ, লালন বিভাজিত হননি। এঁরা বাস করেন প্রতিটি বাঙালির অন্তরে, বাংলাদেশের হোক বা ভারতেরই হোক। সীমান্ত থামাতে পারেনি হিমালয় থেকে নেমে আসা বঙ্গোপসাগরগামী স্রোতোধারাকেও। উভয় দেশের মানুষ গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, কুশিয়ারা-মেঘনা, তিস্তার পানিতে অবগাহন করি। একই নদীর পানিতে সিক্ত হয় আমাদের সমতলভূমি।

পারিপার্শ্বিকতা আমাদের আলাদা করে রাখলেও বাঙালিরা মনেপ্রাণে এক এবং অভিন্ন। অনেক সময় ক্ষুদ্রস্বার্থ আমাদের মনের মধ্যে দেওয়াল তৈরি করে। আমরা ভুল পথে পরিচালিত হই। এই দেওয়াল ভাঙতে হবে। মনের ভিতর অন্ধকার দানা বাঁধতে দেওয়া যাবে না। ক্ষুদ্র দ্বন্দ্ব-স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারলেই কেবল বৃহত্তর অর্জন সম্ভব। কবিগুরু বলেছেন: নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।/ যদি পণ করে থাকিস, সে পণ তোমার রবেই রবে।/ ওরে মন হবেই হবে।

আমরা মানুষের জন্য কাজ করার পণ করেছি। সে পণ আমরা পূরণ করবই। এ জন্য অর্থনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যোগাযোগটাও সুদৃঢ় করা দরকার। শান্তিনিকেতনে যে ‘বাংলাদেশ ভবন’ প্রতিষ্ঠিত হল, আমি বিশ্বাস করি দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এখানে স্থাপিত পাঠাগার, সংগ্রহশালায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, সাহিত্য, ঐতিহ্য সংক্রান্ত বই এবং দলিলপত্র থাকবে। দুই দেশের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হোক এই ভবন, এই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

Sheikh Hasina Narendra Modi Indo-Bangladesh Bilateral Relationship Rabindranath Tagore

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}