মোমিনার বিয়ে হয়েছিল তেরো বছর বয়সে, তালাক ষোলো বছরে। সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক অবৈধ ঘোষণা করায় সে খুশি। রায়কে স্বাগত জানিয়ে মুর্শিদাবাদে মেয়েদের পদযাত্রায় যাবে বলে তৈরি। কিন্তু বাইশ বছরের ছেলের আপত্তি, তালাক বন্ধের মিছিলে গেলে লোকে নিন্দা করবে। মোমিনার জবাব, ‘তোমাকে বড় করতে অনেক কষ্ট করেছি। ভারতের আদালত আমাদের পক্ষে। আমরা আর ভয় পাই না। এর পর হালালা নিকাহ্ বন্ধ করতে হবে।’
হালালা নিকাহ্ করতে হয়েছিল জাহেদাকে। বিয়ের দু’বছর পর তালাক দিলে পিতৃমাতৃহীন জাহেদা অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতিবেশীদের চাপে স্বামী ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়, কিন্তু ‘হালালা নিকাহ্’ মেনে আগে অপর এক পুরুষকে বিয়ে করে, তার থেকে তালাক নিয়ে তবে ফের বিয়ে করতে পারে আগের স্বামীকে। ক’দিন পরে ফের অন্যত্র বিয়ে করে স্বামী। রায়ের কথা শুনে জাহিদা উল্লসিত। যেন সে তার উপর হওয়া অবিচারের প্রতিকার পেয়েছে।
মুসলিম মেয়েদের অধিকারের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চাপানো আছে ধর্মীয় আইন। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা লক্ষ লক্ষ নারীকে অন্নবস্ত্র, নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করেছে, হালালা-নিকাহ্, বহুবিবাহ সমর্থন করে কার্যত ধর্ষিত হতে বাধ্য করেছে, শীর্ষ আদালতের রায়ের পরে তাদের পিছু হঠতে হতে পারে। রায় ঘোষণার পর সারা দেশে যখন আলোচনায় মুখর, তখনও মোমিনা-জাহেদার মতো মুর্শিদাবাদের গ্রামের মেয়েরা কিছুই শোনেনি। কী করেই বা শুনবে? টিভি, সংবাদপত্র তাদের কাছে পৌঁছয় না। রায়কে স্বাগত জানিয়ে সেমিনার, পদযাত্রা, আলোচনা, প্রভৃতি হলেও প্রত্যন্ত গ্রামের কত মেয়ে তাতে যুক্ত হতে পেরেছে?
রাজ্য সরকার কিন্তু এই বিষয়ে এখনও নীরব। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক যে শক্তি, যার সমর্থকরা ধর্মে আঘাতের ধুয়ো তুলে সরব, সরকারের নীরবতা তাদেরই সমর্থন করছে না কি? অন্য দিকে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের রায়কে তাঁদের কৃতিত্ব বলে প্রচার করছেন!
১৯৮৬ সালের শাহবানু মামলার পর থেকেই মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন ও মুসলিম মেয়েদের জন্য দেওয়ানি আইনের সুরক্ষার দাবি উঠেছে। ভারত জুড়ে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বহু মহিলা সংগঠন। তবু, নারীর অধিকার রক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আইন তৈরি করতে বিলম্ব হচ্ছে কেন? ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, আলবানিয়া, রাশিয়া, চিন প্রভৃতি দেশে পারিবারিক আইন পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইয়েমেন, টিউনিসিয়া, আলজিরিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশেও মুখের কথায় তালাক দেওয়ার প্রথা বন্ধ হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ হয় আদালতে। মরক্কো, মলদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে বহুবিবাহও অবৈধ। অন্তত বাইশটি মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে পারিবারিক আইন পরিবর্তিত হয়েছে। তা হলে, এ দেশে এত বিরোধিতা কেন?
ইসলাম ধর্মেই প্রথম নারীর সম্পত্তির অধিকার, বিবাহে মতদান, বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাবিবাহের অধিকার, শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার অধিকার দেওয়া হয়। আজ সেই অধিকার চাইতে গেলে মৌলবাদী গোষ্ঠী ‘গেল গেল’ রব তুলছে। বলছে, খোদার নির্দেশে তৈরি হয়েছে শরিয়ত, সেখানে কারও কলম চালানোর অধিকার নেই। তা হলে খোদার তৈরি শরীরে তাঁরা ডাক্তারকে ছুরি চালাতে দেন কেন?
আজ মুসলিম সম্প্রদায় সচরাচর ব্যাংক থেকে সুদ নেওয়াকে অধর্ম বলে মনে করে না। যে কোনও অপরাধের বিচারের জন্য মুসলিম সমাজ ভারতীয় ফৌজদারি আইনের বিচারপ্রার্থী। শুধু মেয়েদের উপর পুরুষরা যে অবিচার, অত্যাচার করে, সে গুলি থাকবে আদালতের বাইরে। কোনও ধার্মিক এমন দাবি করতে পারে? মহান নবি হজরত মহম্মদের নির্দেশ স্মরণ করেই বলতে হচ্ছে, ‘শরিয়তের দ্বারা কোনও সমস্যার সমাধান না হলে মনুষ্যত্বকে কাজে লাগাবে।’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য চাই আইনি সুরক্ষা। এখানেই তাঁদের যথার্থ মর্যাদা।
ভারতীয় আইন মুসলিম নারীদের সেই সুরক্ষা দেয়নি বলে যুগ যুগ ধরে বিপন্ন হয়েছেন তাঁরা। এ বার রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে মেয়েদের পাশে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মুসলিম মেয়েরা মুক্তির স্বাদ খুঁজে পেয়েছে। এ বার কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার তাঁদের পাশে থাক। আর কোনও মুসলিম মেয়ে যেন অবৈধ বিচ্ছেদের শিকার না হয়, স্বামী-শ্বশুর যেন তাঁকে প্রতারণা করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের কাজ।
রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy