নাবালিকাদের নিয়ে মুর্শিদাবাদের জাকিরুনের (‘জাকিরুন আপা আর তাঁর দৌড়’, ২৭-১২) লড়াইয়ের পর্বটা শুরু হয় পুরুলিয়ার রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের লড়াইটা সামনে আসার পরে। নারী পাচার, নাবালিকা বিয়েতে মুর্শিদাবাদ তখন বেশ এগিয়ে। তত দিনে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন জাকিরুন। তাঁর নিজস্ব একটা নেটওয়ার্ক ছিলই। সেটাকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয় নাবালিকা বিয়ে রোখার কাজ। হরিহরপাড়ার বিডিও পূর্ণেন্দু সান্যাল বলছেন, ‘‘জাকিরুনের নেটওয়ার্ক ঈর্ষা করার মতো। কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের নিয়ে উনি যে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন তার তুলনা হয় না।’’
সে কাজে গতি আরও বাড়াল কন্যাশ্রী প্রকল্প। এখন হরিহরপাড়া ব্লকে ৮৫ কন্যাশ্রী যোদ্ধার সেনাপতি জাকিরুন। সেই সঙ্গে রয়েছেন সবলা প্রকল্পের ৪৫৪২ জন মেয়ে। ‘সোর্স’, ‘নেটওয়ার্ক’ এখন এতটাই দৃঢ়, পাড়ার দোকানে কেউ পাঁজি কিনলেও জাকিরুনের কাছে খবর চলে আসে মুহূর্তে। গত ছ’মাসে ৫২টি নাবালিকার বিয়ে রুখে দিয়েছেন জাকিরুন ও তাঁর যোদ্ধারা। সেই নাবালিকাদের বাবা-মায়েদের অনেকেই এখন জাকিরুনের ভাল ‘সোর্স’।
যোদ্ধাদের অনেকেও উঠে এসেছে বিয়ের মণ্ডপ থেকে। সাহিনা খাতুন, ফজিলা খাতুন, সঙ্গীতা বিশ্বাসদের মতো যোদ্ধারা ভীষণ সক্রিয়। তারা আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণও নিয়েছে। সদ্য বিয়ে-ভাঙা মোমিনাও মনে মনে ‘জাকিরুন আপা’ হতে চায়। কিন্তু মোমিনাদেরও নিত্যসঙ্গী লড়াই। প্রশাসন সংবর্ধনা দেয়। স্কুল সমীহ করে। কিন্তু বিয়ে ভাঙার পর থেকে বাড়ির লোকজনের কাছে যে আচরণ সহ্য করতে হয়, তা মোমিনারাই জানে। এবং এর পরেও তো বহু মোমিনার লুকিয়ে বিয়ে হয়। নাবালিকার বিয়ে বন্ধের থেকে নাবালিকা মায়ের সংখ্যা এখনও অনেক বেশি।
চোয়াল শক্ত হয় জাকিরুনের, ‘‘নিশ্চিত থাকুন, এ ছবি বদলাবেই। মশালের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে মশাল ধরা হাতও।’’ মশালের আলোয় যেমন অন্ধকার দূর হয়, কখনও কখনও ছেঁকাও লাগে। মাসখানেক আগে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে গিয়েছিলেন জাকিরুন। রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। সেই রেজিস্ট্রারের ছেলে আবার জাকিরুনের ছেলের বন্ধু। এ বার আর অন্য কেউ নয়, ফোন করে জাকিরুনের বছর ষোলোর একমাত্র ছেলে, ‘‘মা, এ সব তুমি এ বার বন্ধ করো!’’
জাকিরুনের বুক কেঁপে উঠেছিল। ভয়ে নয়, ছেলের কথা শুনে। ছেলেকে বোঝাতে না পারলে তিনি লোকজনকে কী করে বোঝাবেন? ছেলেও একবগ্গা। ফোন করে সে নানা অভিযোগ করে মাসিকে। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান ইলিয়াসও। সংসারে টানাটানির সময়ে মন ভেঙে যায় ইলিয়াসেরও। তখন তাঁরও মনে হয়, ‘‘এ তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। দিনরাত ছুটতে ছুটতে নানা সমস্যায় ভুগছে মেয়েটা। টাকা নেই, পয়সা নেই। শুধু শুধু শত্রু বাড়ানো। কী হবে এ সব করে!’’ ফের হাল ধরতে হয় জাকিরুনকেই।
মুর্শিদাবাদের মানচিত্রে হরিহরপাড়া একটা ব্লক। কিন্তু জাকিরুন বিবি জানেন, আসলে সেটা লড়াইয়ের ময়দান। নিরন্তর সে লড়াই চলে বাইরে এবং ঘরেও। সেখানে হেরে যাওয়া আর মরে যাওয়ার মধ্যে কোনও ফারাক নেই।
সেই সকালে বেরিয়েছিলেন জাকিরুন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এখনও রান্না হয়নি। দ্রুত তৈরি হয়ে উনুনে হাঁড়ি বসান। গরম ভাতের গন্ধে ম ম করে বাড়ি। খাওয়া শেষ হলে ইলিয়াস খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জাকিরুনের ছবি দেখিয়ে ছেলেকে বলেন, ‘‘এই দেখ, ভাল কাজ করলে এক দিন তোরও ছবি বেরোবে।’’
ভরসন্ধ্যায় ফের ফোন বাজে জাকিরুনের। ও প্রান্তের গলায় কাতর আর্তি, ‘ও আপা, শিগগির...।’
আলো-আঁধারে পতি-পুত্রের মুখের রেখা ঠিক বোঝা যায় না। আপা ফের ছুটতে থাকেন।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy