Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অস্থির সময়ে ভরসা দিল নয়া প্রজন্ম

কিন্তু, যে দেশে মানুষের শিক্ষার অবস্থা নড়বড়ে, দু’বেলা অন্ন সংস্থানেই অধিকাংশের নাভিশ্বাস ওঠে, সেখানে এই প্রাচীন কাগজ কত জনের কাছে থাকবে? তাছাড়া কয়েক দশক ধরে বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বহু কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। লিখছেন মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়।ভিটেমাটি ছাড়ার যন্ত্রণা যে কত গভীর, দেশভাগের পরে যাঁরা খণ্ডিত ভারতে এসেছিলেন, তাঁরা সবাই জানেন।

—ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ০২:৪৭
Share: Save:

মহাভারতে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে যা প্রশ্ন করেছিলেন, তার অন্যতম হল সুখী কে? যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন, অঋণী, অপ্রবাসী, যিনি দিনান্তে নিজের ঘরে বসে দু’টি শাকান্ন খেতে পারেন, তিনিই সুখী। হাজার বছর ধরে এই সংজ্ঞাটি সমাদৃত। লক্ষনীয় যে, প্রবাসী এবং নিজের ঘর— এই কথাগুলি মানুষের এক বিশেষ অবস্থানকে বোঝায়। মানুষ তো আর শূন্যের উপরে ঘর বানায় না। তার ঘর থাকে মাটির উপরে, জমিতে, যার উপরে গড়ে ওঠে তার পরিবার, তার পরবর্তী প্রজন্ম, তার বৃক্ষলতা, তার পশুপাখি। আর তার আঙিনায় দাঁড়ালেই সে দেখতে পায় তার পড়শিকে, ডাক দিলেই যে সুখের-দুঃখের ভাগ নিতে আসে। এই মাটিই তার দেশ, যেখানেই তার ঘর।

ভিটেমাটি ছাড়ার যন্ত্রণা যে কত গভীর, দেশভাগের পরে যাঁরা খণ্ডিত ভারতে এসেছিলেন, তাঁরা সবাই জানেন। সেই বেদনা গুঞ্জরিত হয়েছে এই সব পরিবারের আনাচে কানাচে। সত্তর বছর কেটে গেল, নতুন প্রজন্ম যারা জন্মেছে এ দেশে, তাদের পরবর্তী প্রজন্মও বেড়ে উঠেছে। আর এখন যদি হঠাৎ বলা হয়, এ দেশটা তোমার, তার প্রমাণ তোমাকেই দিতে হবে, তখন সে এক আগ্রাসী বিপন্নতা!

ঠিক সেটাই ঘটছে ভারতে। সাম্প্রতিক কালে এ দেশে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি অর্থাৎ এনআরসি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ এমনই আশঙ্কা তৈরি করেছে গোটা দেশের মনে, যার ফলে গণ-বিক্ষোভে সময় উত্তাল। তৈরি হয়েছে এক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যেখানে তরুণ প্রজন্ম দাঁড়িয়েছে সকলের আগে। বর্তমানের অস্থির পরিস্থিতিতে এটাই যা ভরসা জোগায়!

এনআরসি নিয়ে চর্চা ছিল মূলত প্রতিবেশী অসমে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত সেখানে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তারই ফলে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের চুক্তি হয়। তার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট এনআরসি তৈরি করার নির্দেশ দেয়। চার বছর ধরে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে ৩১ অগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় দেখা গেল, প্রায় উনিশ লক্ষ মানুষের নামই নেই! নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে সাধারণত যে-সব কাগজপত্র লাগে অর্থাৎ রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড— সেগুলিকে বাদ দিয়ে বলা হলো ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগের কোনও সরকারি নথি চাই, যেখানে বাপ-ঠাকুরদার নাম আছে। আর সেই নথি নিয়ে দফতরে জমা দিতে হবে সেই মানুষটিকেই।

কিন্তু, যে দেশে মানুষের শিক্ষার অবস্থা নড়বড়ে, দু’বেলা অন্ন সংস্থানেই অধিকাংশের নাভিশ্বাস ওঠে, সেখানে এই প্রাচীন কাগজ কত জনের কাছে থাকবে? তাছাড়া কয়েক দশক ধরে বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বহু কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। কাগজের অভাবে বহু মানুষ দিশাহারা। এখানে সবচেয়ে বিপর্যস্ত মেয়েরা। কেন না বিয়ের পরে তাদের বাসস্থান শ্বশুরবাড়িতে, কিন্তু জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে নাম ওঠাতে গেলে বাপের বাড়ির নথি প্রয়োজন। অসমে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় নাম ওঠেনি যাঁদের, তাঁদের সংখ্যা প্রায় ১৯ লক্ষ। অর্থাৎ, বিপন্ন ১৯ লক্ষ পরিবারও। একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নাম নেই, বাকিদের আছে। বাবার আছে তো ছেলের নেই, স্বামীর আছে তো স্ত্রীর নেই। এর মধ্যে বেশ কয়েক জন সন্দেহভাজন হিসেবে বছর তিনেক ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক। নথিপত্রে গোলমাল, নাম বিভ্রাট বা অন্য কোনও কারণে বহু মানুষ আটকে আছেন। যাঁরা পারছেন আইনি লড়াই লড়ছেন। যাঁদের সে ক্ষমতা নেই, তাঁরা অথৈ জলে। আতঙ্কে বহু মানুষ আত্মহত্যা করছেন।

এ দেশে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকেই বহুজন বঞ্চিত। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং তার উপরে রোজগারের ব্যবস্থা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।‌ অর্থনীতি তলানিতে ঠেকেছে। এর মধ্যে এই কাগুজে প্রমাণের দায় গোটা সমাজকে অস্থির করে তুলেছে। তার উপরে এসে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। এ নিয়ে আগেও জলঘোলা হয়েছে। কিন্তু, সে সময় সংসদে বিলটি পাশ করা যায়নি। অসমে বাদ পড়া ১৯ লক্ষের মধ্যে বড় অংশ হিন্দু হওয়ায় রাজনৈতিক ভাবে সরকারপক্ষের উপরে চাপ বাড়ে। ইতিমধ্যে দেশব্যাপী এনআরসি ঘোষণা হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে সংসদে পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে আইনে পরিণত হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। এই আইনে বলা হয়েছে, এনআরসি-তে যে সমস্ত মানুষ বাদ পড়বেন, তাঁদের মধ্যে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তারা যদি প্রমাণ করতে পারেন তাঁরা প্রতিবেশী তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হয়ে এসেছেন, তাহলে তাঁরা শর্তসাপেক্ষে নাগরিকত্ব পেতে পারেন। কিন্তু মুসলমানেরা এই সুযোগ পাবেন না। এখান থেকে আরও একটি সঙ্কট দেশ কাঁপিয়ে দিল। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কোনও ক্ষেত্রেই ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ করা যায় না। অনেকেই মনে করছেন, নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে বাছাই করে শুধু মুসলমানদের বাদ দেওয়ায় স্পষ্ট ভাবে সংবিধানের মূল ভাবনায় আঘাত লেগেছে।

আজকের ভারত হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-জৈন-পারসিক জনজাতি সকলের মিলিত ঐতিহ্যে নির্মিত এবং গোটা দুনিয়ার কাছে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তার ধর্মনিরপেক্ষ সহনশীল বহুত্ববাদী গণতন্ত্র। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এখানে আঘাত করেছে মনে করায় দেশের বিরাট অংশের মানুষ আজ প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। ভাবতে ভাল লাগে রবীন্দ্রনাথ, গাঁধী, অম্বেডকর, নজরুল, রোকেয়ার যে ভারত ভাবনা— তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ পথে নামছেন। তাঁরা স্পষ্ট বার্তা দিলেন, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তাঁরা মানছেন না। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াই সমাজের বিভিন্ন প্রবাহের মানুষ পথে নেমেছে। বিদ্বজ্জন, ছাত্র-ছাত্রী এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ এই আন্দোলনে আছেন।

আর একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে, মেয়েদের বিশেষ করে তরুণীদের এই আন্দোলনে একেবারে সামনের সারিতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সরকার পক্ষ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপর আঘাত হানছে, তখন তারা হিংসার সামনে, সন্ত্রাসের সামনে রুখে দাঁড়াচ্ছেন, অহিংসার কথা বলছেন, মৈত্রীর কথা বলছেন। এ এক নতুন ভারতের উত্থান। মেয়েরা হিজাব পরেই থাকুক অথবা পশ্চিমী পোশাকে, তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গান গাইছে। তাদের হাতে সংবিধান ও জাতীয় পতাকা। যখনই কারও ধর্মীয় পোশাক নিয়ে কেউ কটাক্ষ করছেন, তখনই সেই পোশাক অন্য ধর্মের মানুষ পরে নিচ্ছেন অর্থাৎ কোনও বিশেষ চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টাকে বর্জন করা হচ্ছে। মানুষের যে মানবিক পরিচয়, সেটাকেই সবার আগে রাখা হল। এ দেশের গণ-আন্দোলনে মানুষের হাতে এত জাতীয় পতাকা ইদানীং কালে দেখা যায়নি, মানুষের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের পতাকা দেখে। এই উদার জাতীয়তাবোধই হয়তো শেষ পর্যন্ত রুখে দিতে পারবে ভারতকে একটি সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক একনায়কতন্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় স্তবকে ‘হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রিস্টান’কে নিয়ে যে ‘প্রেমহার’ গাঁথার কথা বলেছেন কবি, সেখানে কোনও এক জনও বাদ পড়বেন না, বরং মিশে থাকবেন এ দেশের বহু বিচিত্র ধর্ম ভাবনার আদিবাসী ও অন্যান্যরা। তবেই না জনগণ-ঐক্য-বিধায়কের জয়ধ্বনি উঠবে। নতুন প্রজন্ম সেই ভরসাই দিল।

লেখক স্কুল শিক্ষিকা ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NRC CAA Student Movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE