শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মকে যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করিয়াছিলেন, অনৃশংসতাই যদি ধর্ম হয়, তাহা হইলে রাজা প্রাণদণ্ড দিবেন কী রূপে? আর যদি অপরাধীকে দণ্ড না দিতে পারেন, তবে ধর্মরক্ষা হয় কী রূপে? উত্তরে ভীষ্ম শুনাইয়াছিলেন সত্যবান এবং দ্যুমৎসেনের বিতর্ক। দ্যুমৎসেনের বক্তব্য, সত্য বা ত্রেতা যুগে পুরজনের ধিক্কার কিংবা গুরুজনের কঠোর বাক্যই মানুষকে অধর্ম হইতে নিরত করিতে পারিত। দ্বাপরে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিলেই যথেষ্ট দণ্ড হইত। কিন্তু কলিযুগে অপরাধীর প্রাণদণ্ড ভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নহে। সত্যবান দুইটি প্রতিযুক্তি দিয়াছিলেন। এক, কোনও ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দিলে তাঁহার পরিবারের সদস্যদেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়। তাহা নিরপরাধের শাস্তি, অতএব অধর্ম। দুই, সময়ের সঙ্গে অনেক অপরাধী সংশোধিত হন। প্রাণদণ্ড দিলে উত্তরণের সুযোগ হইতে তাঁহাদের বঞ্চিত করা হয়। সম্প্রতি ভারতের শীর্ষ আদালত এক অপরাধীর প্রাণদণ্ড মকুব করিল। আঠারো বছর আগে ওই ব্যক্তি এক শিশুকে অপহরণ ও হত্যা করিয়াছিলেন। তখন তাঁহার বয়স বাইশ। উহাই ছিল তাঁহার প্রথম অপরাধ। নিম্ন আদালত এই ভয়ানক হত্যার শাস্তিস্বরূপ ফাঁসির বিধান দেয়, বম্বে হাইকোর্ট তাহা বহাল রাখে। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বন্দি। ইতিমধ্যে তিনি গাঁধীবাদী দর্শনে জীবনের সুর বাঁধিয়াছেন, অনুশোচনা প্রকাশ করিয়া কবিতাও লিখিয়াছেন। কবিতাগুলিকে তাঁহার সংশোধনের প্রমাণ রূপে মান্যতা দিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। ফাঁসির সাজা পরিণত হইয়াছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।
অর্থের জন্য শিশুহত্যা মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু বিচারপতিরা অপরাধীর মনের পরিবর্তনকেও বিবেচনা করিয়াছেন। আইনে অপরাধের তীব্রতা দিয়া শাস্তির কঠোরতা নির্ধারিত হয়। তাই ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণদণ্ড, বা অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে কারাদণ্ডের মেয়াদ নির্ধারণ। কিন্তু অপরাধীর সংশোধনের সম্ভাবনা কিসে অধিক, তাহা বিবেচনা করিয়া বিচারপতিরা অনেক ক্ষেত্রে অন্য প্রকার শাস্তি দিয়াছেন। যেমন, অপরাধীকে সমাজসেবা করিবার নির্দেশ। দিল্লিতে মদ্যপ হইয়া গাড়ি চালাইবার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইবার পর এক যুবককে প্রতি দিন ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা করিবার নির্দেশ দেয় আদালত। অল্প বয়স এবং স্বল্প অপরাধ ঘটিলে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজসেবী সংগঠন বা ধর্মস্থলে সেবামূলক কাজ করিবার নির্দেশ দিয়াছে বিভিন্ন আদালত।
ভারতীয় সমাজের বৃহত্তর অংশ অবশ্য দ্যুমৎসেন-পন্থী। তাই ষোলো বৎসরের কিশোরেরও প্রাণদণ্ডের দাবি উঠিতেছে। যেন অপরাধীর চরম শাস্তি না হইলে অপরাধের গুরুত্ব লঘু হইয়া যায়, নির্যাতিতের প্রতি সুবিচার হয় না। নৃশংস অপরাধের নৃশংস শাস্তি বিধেয়— এই ধারণাটিকে প্রশ্ন করা প্রয়োজন। অপরাধ যতই অমানবিক হউক, তাহার বিচার হইতে হইবে মানবিক, কল্যাণকামী, পরিবর্তনে আস্থাশীল। কারাগারগুলিকে ‘সংশোধনাগার’ বলিলেও, তাহার অভ্যন্তরে অপরাধ কম নহে। অতএব কারাদণ্ডে যে প্রায়শই হিতে বিপরীত হয়, প্রাণদণ্ডের ভীতি সমাজে অপরাধ কমাইতে পারে না, তাহা প্রমাণিত। অপরাধ কমাইতে হইলে অপরাধের প্রবণতা কমাইতে হইবে। কঠোরতার আঘাত অন্তরকে আরও বিক্ষুব্ধ, হিংস্র করে। যাহা অপরাধীর জীবনে উত্তরণ আনিবে, তাহাই উপযুক্ত শাস্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy