Advertisement
E-Paper

গাড়ির পিছনে লেখা থাকে সমাজজীবনের খণ্ডচিত্র

শহর বর্ধমানে পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাকের ব্যবহার সেই বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে। সেই সময় থেকেই ট্রাকের পিছনে ‘নমস্কার’, ‘শুভযাত্রা’ ইত্যাদি কথা লেখা থাকত। তখন থেকেই এই লেখাকে জীবিকা করে তুলেছিলেন এক দল মানুষ। তাঁদের হাতে পড়ে মাঝে মধ্যে চেনা শব্দও অচেনা হয়ে উঠত। লিখছেন শ্রীকান্ত বসুশহর বর্ধমানে পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাকের ব্যবহার সেই বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে। সেই সময় থেকেই ট্রাকের পিছনে ‘নমস্কার’, ‘শুভযাত্রা’ ইত্যাদি কথা লেখা থাকত। তখন থেকেই এই লেখাকে জীবিকা করে তুলেছিলেন এক দল মানুষ। তাঁদের হাতে পড়ে মাঝে মধ্যে চেনা শব্দও অচেনা হয়ে উঠত। লিখছেন শ্রীকান্ত বসু

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪০
গাড়ির পিছনে নানা লেখা। ছবি: উদিত সিংহ

গাড়ির পিছনে নানা লেখা। ছবি: উদিত সিংহ

মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন এক দল যুবক। হঠাৎ হেসে উঠলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যেই এক জন বলে উঠলেন, ‘‘ভাই একে কেউ নোবেল দে।’’ বিদ্রুপের লক্ষ্য ছিল, গাছের গুঁড়ি বোঝাই একটি ট্রাক। যার পিছনে লেখা ছিল, ‘একটি গাছ একটি প্রাণ, গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান’। বৈপরীত্যই এখানে হাসির খোরাক। এই ঘটনায় হাসি পেলেও, একটা সময় ছিল যখন গাড়ির পিছনে এই লেখাগুলিই ছিল এক শ্রেণির মানুষের জীবিকা।

শহর বর্ধমানে পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাকের ব্যবহার সেই বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে। সেই সময় থেকেই ট্রাকের পিছনে ‘নমস্কার’, ‘শুভযাত্রা’ ইত্যাদি কথা লেখা থাকত। তখন থেকেই এই লেখাকে জীবিকা করে তুলেছিলেন এক দল মানুষ। তাঁদের হাতে পড়ে মাঝে মধ্যে চেনা শব্দও অচেনা হয়ে উঠত। যেমন, পঞ্চাশের দশকে বহু গাড়ির পিছনে লেখা থাকত ‘Bদায় (‘বিদায়’ অর্থে), ‘৮০ বন্ধু’ (‘আসি বন্ধু’ অর্থে)। এখন বর্ধমান, আসানসোল বা দুর্গাপুরের মত শহরে অধিকাংশ পণ্যবাহী গাড়ির পিছনেই কোনও না কোনও বাক্যবন্ধ লেখা থাকে। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করলে এই সব লেখাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়— প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনামূলক, ধর্মীয় ও সংস্কারমূলক এবং স্থানীয় জীবনযন্ত্রণামূলক।

‘দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মতো ফুলবি’, ‘দেখবি যত ফুলবি তত’ জাতীয় লেখাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লেখার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই সব লেখার মধ্যে দিয়ে এক দিকে যেমন গাড়িমালিকদের ব্যবসায়িক রেষারেষি ফুটে ওঠে, তেমনই অন্য দিকে, ফুটে ওঠে গ্রাহককে আকর্ষণের চেষ্টা।

কখনও কখনও সামাজিক বা রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও লেখায় ছায়াপাত করে। যেমন, জরুরি অবস্থার সময় বহু গাড়ির পিছনে লেখা থাকত ‘কথা কম, কাজ বেশি’ বাক্যবন্ধটি। আবার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে গাড়ির পিছনে ঠাঁই করে নিয়েছিল, ‘মেরা ভারত মহান হ্যায়’ জাতীয় লেখা।

অনেক গাড়ির পিছনেই ‘যত মত তত পথ’ বা ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’ জাতীয় বাণী লেখা থাকে। এই সব লেখার উৎস ধর্ম ও লোকবিশ্বাস। মহাপুরুষদের কথা স্মরণ করলে যাত্রা শুভ হবে এমন বিশ্বাস থেকেই এই লেখার সূত্রপাত। কোনও কোনও গাড়ির পিছনে আবার থাকে নানা দেব দেবীর ছবি এবং ‘ওঁ’ কথাটি। আবার কোথাও থাকে ‘মা তারার আশীর্বাদ’ জাতীয় লেখা। আবার গাড়ির মালিক মুসলিম হলে অনেক সময়ে গাড়ির পিছনে লেখা থাকে ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ বা ‘৭৮৬’ নম্বরটি। যাত্রাপথে গাড়ি যাতে সুরক্ষিত থাকে সেই প্রার্থনাই ফুটে ওঠে এ ভাবে।

তবে গাড়ির পিছনে যে কথা লেখা থাকে, তা সবটাই যে গাড়ির মালিকদের কথা, এমনটা নয়। এমন অনেক লেখা থাকে যা উঠে আসে এই লেখার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, সেই সব শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবনের টুকরো টুকরো কিছু অভিজ্ঞতা থেকে। স্থানীয়, ইতিহাস, ভূগোলও অনেক সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে এই সব লেখার পিছনে। যেমন, বর্ধমানের রাস্তায় চলা একটি গাড়ির পিছনে লেখা দেখেছিলাম, ‘পাহার থেকে ঝর্ণা ঝরে আকাশ থেকে নয়/ বর্ধমানে ধান ফলে, কমলালেবু নয়’। বোঝাই যায় এই লেখার মূলে কাজ করেছে কৃষিভিত্তিক বর্ধমানের কথা। দারিদ্র বা সংগ্রামের কথা কখনও মূর্ত হয়ে ওঠে লেখার মধ্যে দিয়ে। মাঝেমধ্যেই গাড়ির পিছনে ‘জন্ম থেকেই চলছি’ বা তেলের ট্যাঙ্কের গায়ে ‘জন্ম থেকেই জ্বলছি’ প্রভৃতি লেখা চোখে পড়ে।

দেখা গিয়েছে, যাঁরা এই লেখার কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশই দরিদ্র শিল্পী। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে এই কাজ করেন। ট্রাক, বাস বা ট্রাক্টরের বডি যেখানে তৈরি হয় তার আশপাশে দেখা মিলবে এই সব শিল্পীদের। এই কাজ থেকে নিয়মিত আয় আসে না। কোনও দিন কাজ জোটে। সে দিন অবশ্য চার-পাঁচশো টাকার মতো আয় হয়। হাতের লেখার উপরে মজুরির অঙ্ক ওঠা-নামা করে। যদিও রঙের খরচ শিল্পীকেই দিতে হয়। এঁদের কেউ কেউ অবশ্য গাড়ির কাঠামোও রং করেন। এই সব শিল্পী এবং গাড়ির মালিকদের হাত ধরে আজও টিকে রয়েছে এই শিল্প। সঙ্গে নতুন ভাবনাও যুক্ত হচ্ছে।

বর্ধমানের সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মী

Cars Quotes
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy