Advertisement
E-Paper

প্রতিযোগিতা সংঘাত নয়

সাংহাই শহরে সুউচ্চ আধুনিক অট্টালিকার পাশাপাশি প্রাচীন রুশ স্থাপত্যের বাড়ি। অদ্ভুত এক মিশ্রণ। চিনা সরকারের প্রতিনিধিরা বার বার আমাদের বোঝাতে চাইছিলেন, সাংহাই ম্যানহাটানকেও আজ টপকে গিয়েছে।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
নায়ক: চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে ভাষণ দিচ্ছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট ও পার্টির কর্ণধার শি চিনফিং। বেজিং, ১৮ অক্টোবর। ছবি: এএফপি

নায়ক: চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে ভাষণ দিচ্ছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট ও পার্টির কর্ণধার শি চিনফিং। বেজিং, ১৮ অক্টোবর। ছবি: এএফপি

সরকারি আমন্ত্রণে কিছু দিন আগে সমাজতন্ত্রী চিনে গিয়েছিলাম। প্রোটোকল অফিসারদের অনেক করে বললাম, কনফুসিয়াস আর বৌদ্ধ মন্দিরগুলো দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করছে। শুনেছি এখন চিনা সরকার এই সব প্রাচীন মন্দির সংস্কার করছে। সপ্তদশ পার্টি কংগ্রেসেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সমস্ত ধর্মীয় সৌধ, এমনকী মসজিদ পর্যন্ত পুনর্নির্মাণ করবে। কনফুসিয়াস দর্শনের প্রাসঙ্গিকতাকে নতুন করে গ্রহণের কথাও সর্বজনবিদিত। কিন্তু চিঁড়ে ভেজেনি। অতীত দেখানোর চেয়ে ওঁদের অনেকগুণ বেশি উৎসাহ সাংহাই শহরের বৈভব প্রদর্শনে।

সাংহাই শহরে সুউচ্চ আধুনিক অট্টালিকার পাশাপাশি প্রাচীন রুশ স্থাপত্যের বাড়ি। অদ্ভুত এক মিশ্রণ। চিনা সরকারের প্রতিনিধিরা বার বার আমাদের বোঝাতে চাইছিলেন, সাংহাই ম্যানহাটানকেও আজ টপকে গিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, ফুটপাত লাগোয়া ল্যাম্পপোস্টে বাঁধানো বোর্ডে লেখা, ১৯২১ সালে এই বাড়িতে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। প্রথম পার্টি কংগ্রেসে হুনান কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে হাজির ছিলেন মাও জে দং।

কলকাতার ছেলে। ওই সাদামাটা পুরনো বাড়িটির ভিতরে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। সেই ঐতিহাসিক স্থানটি না দেখিয়ে লিয়াজোঁ অফিসার আমাদের নিয়ে গেলেন সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ দেখাতে। অনেক অনুরোধের পরে বেজিংয়ে ওঁরা মাও জে দং-এর সমাধিস্থল, এমনকী তিয়ানেন মেন স্কোয়ারটিও দেখালেন, দেখলাম এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাওয়ের সমাধিস্থলে সেনাবাহিনীর গার্ড অব অনার অনুষ্ঠান হয়।

আমাদের দেশে বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক বা যে কোনও অতিথি এলেই আমরা তাঁদের তাজমহল বা লালকেল্লা দেখাতে মরিয়া হই, চিন কিন্তু উল্টো। তারা অতীতের চেয়ে দেখাতে চায় পুঁজিবাদী বৈভব। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি।

দ্রুত এক শক্তিশালী চিন গড়তে চাইছে ওরা। টক্কর দিতে চাইছে আমেরিকাকে। বার বার সেটাই দেখাতে চায় তারা। সেটাই দেং জিয়াও পিং থেকে আজকের শি চিনফিং-এর ‘চিনা স্বপ্ন’। দেশের বাইরেও জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি ছিনিয়ে নিতে চায় চিন, নিজেদের ঘর থেকে বাইরে প্রসারিত করে।

উনিশতম পার্টি কংগ্রেস হয়ে গেল। এই অধিবেশনে শি সংবিধান অনুসারেই আরও পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকার সিলমোহর লাভ করলেন। দেশের মধ্যেও অতীতের মাঞ্চু সম্রাটের পর একমাত্র মাও জে দংকে কিঞ্চিৎ স্বীকার করে বাকি সকলের ছবি মুছে দিয়ে চিন মানেই হয়ে উঠল শি চিনফিং। ডোকলাম বিতর্কের সময়ে ঠিক এই কারণেই এক চিনা কূটনীতিক আমাকে বলেছিলেন, আপনারা যতই পেশি প্রদর্শন করে চিনকে পরাস্ত করতে চান মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে, শি চিনফিং-এর পক্ষে এখন পার্টি কংগ্রেসের আগে দলের সামনে দেশের সামনে এবং দুনিয়ার সামনে পিছু হটার কূটনৈতিক বার্তা দেওয়া অসম্ভব। টাইমিং রং।

চিনের পার্টি কংগ্রেস চলার সময়ে যে ভাবে মার্কিন বিদেশ সচিব টিলারসন ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন, ভারত আহ্লাদিত। কিন্তু এতে এশিয়ার এই প্রান্তে কূটনৈতিক সংঘাত আরও বেড়েছে। চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক আর্থিক বাধ্যতামূলক বোঝাপড়ার দিকটি রয়েছে। আবার এটাও নির্মম সত্য যে এই দুই দেশের প্রকৃত সম্পর্ক অহিনকুল। এডগার স্নো- কিসিংগার এবং নিকসনের বরফ গলানোর প্রয়াস আজ ইতিহাস।

আজ চিন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর)-কে তাদের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরে প্রবলপরাক্রান্ত বিশ্বব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছে। সেটা ট্রাম্প-বাবুর কিছুতেই ভাল লাগতে পারে না। তার উপর আছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অ্যাডভেঞ্চার। তাই চিন পাকিস্তান, রাশিয়া অক্ষ গড়ে তোলার চেষ্টা শুধু নয়, ভুটান-বাংলাদেশ পর্যন্ত ভারতের প্রতিবেশী প্রতিটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে অতিসক্রিয় চিন। আমেরিকার ভারত প্রেমের নিদর্শন দেখলে মোদীর সরকারের আহ্লাদ হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী? টিলারসন ভারতে এলে, বিশেষত আফগানিস্তান সমস্যার সমাধানে তাঁরা সাহায্য করতে চাইলে তা গ্রহণ করাই উচিত কাজ।

মনে রাখছি, ২৬/১১ মুম্বই-সন্ত্রাসের পর যখন আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন চিন কী করেছিল।

সরাসরি পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত না করে চিন পরামর্শ দিয়েছিল, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বসে যৌথ ভাবে ঘটনার তদন্ত শুরু করুক। ভারত আলোচনাতেই বসতে চাইছিল না যখন, তখন চিন চাপ দিচ্ছিল দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করতে। যা আসলে পাকিস্তান চাইছিল। সে সময় আমেরিকা ও ইজরায়েল অবশ্য প্রভূত সাহায্য করেছিল।

চিনকে চাপে রাখতে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা ভারতের প্রয়োজন। মোদীজি সেটাই করছেন। কিন্তু অনাবৃষ্টির মতো অতিবৃষ্টিও ভাল নয়। মার্কিন প্রেম যদি অতি নির্ভরশীলতার জন্ম দেয়, তারও বিপদ রয়েছে। জোটনিরপেক্ষ নীতি ঘোষণা করেও নেহরু-ইন্দিরার বিদেশ নীতিতে সোভিয়েত-নির্ভরতা বেশি হয়ে উঠেছিল তৎকালীন ভারসাম্যের বিশ্ব রাজনীতিতে। ন্যাম হয়ে যায় সোভিয়েত ছাতার তলায় পালিত এক সংস্থা। আবার আজ যদি চিনকে চাপে রাখতে বিদেশ নীতি আমেরিকা-নির্ভর হয়ে ওঠে, তা-ও কাম্য নয়। আমেরিকা ভারতকে তত ক্ষণই সমর্থন করবে, যত ক্ষণ সেটা তার নিজের স্বার্থের অনুকূল। ভারতেরও সেটাই করা উচিত, যা ভারতের স্বার্থ।

চিনের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়াও তাই ভারতের ভুল কূটনীতি। উচিত একটাই। সেটা হল একটা ত্রিভুজ— ভারত, চিন ও আমেরিকা। মনে আছে, বাজপেয়ী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ বলে ফেলেছিলেন, চিন হল পাকিস্তানের থেকেও বড় শত্রু। বাজপেয়ী তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, একসঙ্গে দুটো ফ্রন্ট উন্মুক্ত করা ভুল কূটনীতি। আমেরিকার সঙ্গে চিনের সংঘাত আছে ভেবে আমেরিকার জো হুজুর হওয়া ঠিক বিদেশনীতি নয়। বরং চিন ও আমেরিকা, দু’পক্ষের সঙ্গেই যদি মৈত্রীর কথা বলে আমরা এগোই। তবে দুটি দেশের কাছেই গুরুত্ব থাকবে। এই মধ্যপন্থার কূটনীতির জন্য পেশাদারি মুনশিয়ানার প্রয়োজন অনেক বেশি।

মোদী সরকারের বিদেশ নীতিতে বড় বেশি দোদুল্যমানতা। মুনশিয়ানা দেখছি কই? শুধু অপটিক্স দিয়ে কি বিদেশ নীতি হয়? সিঁদুরে মেঘ দেখলে তাই ভয় পাই।

Xi Jinping China Diplomacy US Foreign Policy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy