Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

যন্ত্রণা ও হতাশা জয় করে সত্যিই সুন্দর হয়ে উঠুন

নিজেকে আরও ভালবাসুন। গায়ের কালো রং উদযাপন করুন। জীবন মহৎ। একে পার্লারের গণ্ডিতে না বেঁধে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামযে কালো মেয়েটি এক দিন ‘কোনি’ হয়ে উঠতে পারতেন তিনি ফেয়ারনেস ক্রিম মাখতে মাখতে এক দিন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন।

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:৪৪
Share: Save:

সাম্যবাদ সাম্যের কথা বলে। মানবতাবাদ মানুষের কথা। বর্ণবাদ কিন্তু চিরকাল বিশেষ একটি বর্ণের কথাই চিৎকার করে জানান দেয়। কাউকে তাঁর মানবিক গুণের বদলে চেহারার মাপকাঠিতে বিচার করা অন্যায় ও অশিক্ষা। সেই ধারাবাহিক লজ্জার ইতিহাসে আত্মগোপন করে আছে অসংখ্য নাম, এবং সেই সব কালো মেয়েদের যন্ত্রণা। মাত্র দু’টি অক্ষরের একটি শব্দ— ‘কালো’। এই শব্দ মিশাইলের মতো কাজ করে। ছুড়ে দিলেই কেমন কুঁকড়ে যান মেয়ে। অসম্মানিত বোধ করেন। অসহায় হয়ে পড়েন। আসলে গায়ের রঙের ভিত্তিতে যাঁরা মানুষকে অপমান করেন তাঁদেরই লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু একটা উল্টো পিঠকেই আজীবন সঙ্গ দিয়ে এসেছে আমজনতা। যে মধ্যযুগীয় ভ্রান্ত কথাগুলোর মিটে যাওয়ার কথা। সেগুলিই প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে দেওয়াল জুড়ে, বন্ধ দুয়ারে। এবং প্রকাশ্যেও। নীচের এই বাক্যগুলি প্রশ্রয় পেতে পেতে স্তোত্রের মতো হয়ে গিয়েছে

— আপনি তো বেশ ফর্সা। তবে মেয়ের রংটা এত কালো হল কেন?

— মেয়েটি কাঠকয়লা কিন্তু বাবা-মা দিব্যি পরিষ্কার।

— মেয়েটি খুব জেদি। অবশ্য কালো মেয়েরা একটু জেদি হয়।

— কালো হলেও চোখ-মুখ ভাল। মাথায় অনেক চুল রয়েছে।

— বড় হলে এত কালো থাকবে না। বিয়ের পরে ফর্সা হয়ে যাবে ।

— মেয়েদের বেশি চা খেতে নেই। রং কালো হয়ে যাবে।

প্রশ্ন হল, কালোকে কালো বললে কী সমস্যা? এখানে তো সেই আফ্রিকান ও আমেরিকানদের মতো আভিজাত্যের সীমানা নেই। অপমানের বঞ্চনা নেই। বৈষম্যের সেই উঁচু-নিচু নেই। তবে? আছে মানবিকতার অপমান। মনুষত্ব্যের অবমাননা। মানুষকে চেহারার কারণে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জীবন যাপন করানোর মধ্যে সমাজের কোনও কৃতিত্ব নেই। গায়ের রঙের ক্ষতিপূরণ মেয়েরা আর কত দিন দিয়ে যাবেন? সুন্দর ও ফর্সাকে আমরা কম্পলিমেন্ট ধরি। কালোকে অপমানের। মানুষের অজ্ঞতার বশে নির্মিত এই অমানবিক প্যারামিটারে এ বারে ছেদ টানা জরুরি।

মিডিয়া ও সৌন্দর্য শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার এক বিরাট ভূমিকা আছে এই কালোদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য। কালো রং অযোগ্যতারই পরিচায়ক— এটা প্রচার করতে মিডিয়া ব্যস্ত। বিশ্ব জুড়ে ফেয়ারনেস ক্রিমের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে মাথায় রেখেই এ জাতীয় ব্যবসা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে। বিজ্ঞাপনে একটি মেয়ের শিক্ষা, যোগ্যতাকে খাটো করে দেখানো হয় গায়ের রঙের কারণে। তার পরে যাদুকাঠি ছুঁইয়ে রাতারাতি চামড়ার রং বদলে দেওয়া ক্রিমকেই সব সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চলে। দেখানো হয়, ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত সেই কালো মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না। পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন না।

প্রথম সারির নায়িকাদের বিরুদ্ধে উঠেছে স্কিন লাইটেনিং-এর অভিযোগ। সিনেমার পর্দায় নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে তাঁদেরও রং বদলানোর দরকার হচ্ছে। তবে কি যোগ্যতার চেয়ে বর্ণই মুখ্য? বিতর্ক হোক। বিচার হোক। সচেতনতা ফিরুক।

ত্বক উজ্জ্বল করার যে কোনও রকমের ক্রিম বা প্রসাধনীকে নিষিদ্ধ করেছে ঘানা। এই ধরণের ক্রিমে ক্যান্সার হতে পারে এমন জিনিস ব্যবহার করা হয় বলেই এই সিদ্ধান্ত। স্কিন ব্রাইটেনিং-ও অত্যন্ত সাময়িক। স্থায়ী কোন ব্রাইটেনিং পদ্ধতি নেই। পিলিং বা ট্যান রিমুভের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার সঙ্গে জন্মগত কালো রং ফর্সা করার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু কালো রং নিয়ে দরবার করলেও সেই পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা চলে। আসলে এটি একটি বিরাট প্রতারণা। বাজারে রমরমিয়ে চলছে গ্লুটাথিয়ন ক্যাপসুল ও ইনজেকশন। ইউএস ফুড ও ড্রাগ আডমিনিস্ট্রেশন একে অনুমোদন দেয়নি। তবুও কালো মেয়ের মনোবল ফেরাতে মারণাস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। ক্ষতিকর যাবতীয় কিছু অবলীলায় বিপুল টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু এক বারও বলা হচ্ছে না, ‘‘আপনি কালো। কোনও দিনই ফর্সা হবেন না।’’

তাই নিজেকে ভালবাসুন। নিজের গায়ের কালো রং উদ্্যাপন করুন। জীবন মহৎ। একে পার্লারের গণ্ডীতে না বেঁধে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন। বাঁচতে গেলে অক্সিজেন দরকার। মানুষের ভিত্তিহীন কমপ্লিমেন্ট বা অবজ্ঞা নয়, যন্ত্রণা ও হতাশাকে জয় করুন। দেখবেন, ধীরে ধীরে আপনিও সত্যিই সুন্দর হয়ে উঠছেন।

প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে এই ‘কালো’ অপমানে কী ভাবে হারিয়ে যায় একটি তরতাজা মন? তার কোনও পরিসংখ্যান নেই। বৈষম্য নিয়ে লক্ষ লক্ষ শব্দ খরচ হয়। কালো রং নিয়ে যে বৈষম্য সেই প্রশ্নে কেমন ঠোঁট ওল্টান বহু মানুষ। হেসে বলেন, ‘‘এটা কোনও সমস্যা হল? সবাই মানুষ। বাদ দিন তো!” কিন্তু এই বাদ দেওয়া আসলে পালিয়ে বাঁচার কৌশল! সিনেমায় ফর্সা মেয়েকে কালো রং মাখিয়ে পর্দায় দেখানো হয়। লেখা হয় সাহিত্য, গল্প। সহানুভূতিও দেখানো হয়। কিন্তু মনের কালো মুছবে কে? আইন করে রদ করতে হবে এই অন্যায়। কালো বলে অত্যাচার করা হলে অভিযুক্তকে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কোনও সৃষ্টিই হাসি-উপেক্ষা-অমর্যাদার নয়।

যে কালো মেয়েটি এক দিন ‘কোনি’ হয়ে উঠতে পারতেন তিনি ফেয়ারনেস ক্রিম মাখতে মাখতে এক দিন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। কখনও তিনি শিক্ষক, কখনও ঘরের বৌ। সবাই ধিক্কার দিলেন। এক জন শিক্ষিত মেয়ে এত দুর্বল! ঘরের বৌটি পণ নামক অসহায় এক মানিয়ে নেওয়া কুপ্রথার বলি বলে মেনে নিয়ে ভুলে গেল সবাই। কিন্তু যিনি ঘাতক, যিনি প্রথম কালো মেয়েটির মনোবল ভেঙেছিলেন তিনি সমাজে মাথা তুলে বেঁচে রইলেন। আইন করে তাঁকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

কোনও পাত্র কালো মেয়ে বিয়ে করবে কি করবে না সেটা তাঁর একান্ত স্বাধীনতা। ব্যক্তিগত পছন্দ। কিন্তু কালো বলে ব্যঙ্গ–বিদ্রুপ করে মেয়েকে মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া অন্যায়। প্রতিবাদের রাশ এখানে জোরালো হওয়া দরকার। এখন শিক্ষিত ব্যক্তিদের বলতে শোনা যায়, ‘‘রং আজকাল কোনও ফ্যাক্টর নয়, মেয়ে ইন্টেলিজেন্ট হলেই চলবে!” কিন্তু বাস্তবে তা কি হচ্ছে? ভণ্ডামিটা ঠিক এখানেই! কালো মেয়েদের নিয়ে মজা চলছে। আর এই মজাই কখনও বা মৃত্যুবাণের মতো বিঁধছে অগোচরে। মন মরছে। স্বপ্ন মরছে। জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে পিছু হটছেন এক মেয়ে। ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ আন্দোলন হলেও ‘ব্ল্যাক উইথ ইনটেলিজেন্স’ বলার হিম্মত হয়নি কারও। বিশ বাঁও জলের তলা থেকে খালি কৃষ্ণাদের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। এই কান্না আর আফসোসের পরম্পরায় ইতি টানা জরুরি। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মর্যাদা ও আত্মসম্মানের যে সীমানা তাকে বজায় রাখতেই এই সমাজের নির্মাণ। রং-চেহারার কারণে তাই কাউকে অসহায় আক্রমণ করা এক সামাজিক অপরাধ। প্রয়োজনে শাস্তিমূলক বিধান দরকার। কালো ও ফর্সা দুই-ই যে সুন্দর ও স্বাভাবিক তা আর কবে বুঝব আমরা?

(শেষ)

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fair Blackish Complexion Death Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE