ভোট চলিতেছে, তাই ধর্ষণের অভিযোগ না লইয়া ফিরাইয়াছে থানা। সংবাদে প্রকাশ, ষোলো বৎসরের এক নির্যাতিতা কিশোরী ও তাহার মাকে থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক জানাইয়াছেন, ভোট না মিটিলে অভিযোগ দায়ের হইবে না। মুর্শিদাবাদ জেলার এই ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন, সত্য প্রমাণিত হইলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের কঠোর শাস্তির প্রয়োজন। কিন্তু এহ বাহ্য। ওই আধিকারিকের বক্তব্য, নির্বাচনের জন্য থানায় কোনও পুলিশ কর্মী ছিল না। নাবালিকার সহিত মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য কাহাকেও পাঠাইবার উপায় ছিল না বলিয়াই তিনি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন নাই। কিন্তু মূল প্রশ্ন: যে কোনও সরকারি পরিষেবার যেগুলি মৌলিক কাজ, সেগুলি নির্বাচনের জন্য বন্ধ থাকিবে কেন? নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি বিধি। চক্রাকারে নির্বাচন আসিবে ও যাইবে। তাহার ব্যবস্থাপনা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিয়মিত কাজ, বিবিধ জরুরি নাগরিক পরিষেবা তাহার জন্য ব্যাহত হইবে কেন? দীর্ঘ নির্বাচনী মরসুমে প্রশাসন ও পরিষেবার কর্তব্যগুলি যাহাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাহা নিশ্চিত করা দরকার। নাগরিক অধিকারকে খর্ব করিয়া নির্বাচন হইতে পারে না।
অথচ নির্বাচন আসিলে তাহারই দৃষ্টান্ত মিলিতে থাকে। রোগীর জীবনসংশয় দেখা দেয়, কারণ রক্তসংগ্রহের শিবির সংগঠিত হয় না। রক্ত অমিল হইয়া পড়ে। জেলায় জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পঠনপাঠন অনিয়মিত হইয়া পড়ে, এমনকি ছুটিও হইয়া যায়। সরকারি দফতরে বিভিন্ন পরিষেবা খুঁড়াইয়া চলিতে থাকে। পঞ্চায়েতগুলি একশো দিনের কাজ কার্যত বন্ধ করিয়াছে। নাগরিকের কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকারকে খর্ব করিয়া গণতন্ত্রের উৎসব চলিতেছে। কী বিচিত্র এই দেশ! মিছিল, জনসভায় সাধারণের গতিবিধি ব্যাহত হইতেছে। বহু জায়গায় রাস্তা নির্মাণ, পানীয় জলের ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি নিতান্ত জরুরি কাজ বন্ধ হইয়া আছে। নির্বাচনী বিধির জুজু দেখাইয়া সেগুলি এড়াইতেছেন স্থানীয় আধিকারিকরা, যদিও ইহার অনেকগুলিই জরুরি পরিষেবা। সাত পর্বের দীর্ঘ নির্বাচনী প্রক্রিয়া যত দিন চলিবে, তত দিন কার্যত অর্ধেক বা সিকি পরিষেবায় দিন কাটাইতে হইবে নাগরিককে?
সাধারণ নির্বাচন দেশের মধ্যে এক যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করিয়াছে, স্বাভাবিক জীবনের নিয়মশৃঙ্খলা লইয়া কাহারও মাথাব্যথা নাই। ব্যাপার দেখিয়া কেহ বলিতে পারেন, ‘‘উল্টা বুঝিলি রাম।’’ গণতন্ত্রে নাগরিকের প্রয়োজন মিটাইবেন নেতা, এমনই প্রত্যাশিত। কিন্তু ভারতে নেতাই প্রশাসনের নিকট অগ্রগণ্য। সরকারি আধিকারিকরা জনপ্রতিনিধির সম্মুখে জোড়হস্ত, অথচ জনগণের প্রতি খড়্গহস্ত। সকল স্তরের নেতার গাড়ির জন্য নাগরিককে পথ ছাড়িয়া দিতে হয়, জনসভা হইলে যানজটে দীর্ঘ অপেক্ষা করিতে হয়, তাহা নাগরিকের মূল্যহীনতার প্রতীক। উন্নত গণতন্ত্রে জনজীবন ব্যাহত করিলে নেতা ক্ষমাপ্রার্থনা
করিয়া থাকেন। এ দেশে স্বাভাবিক দিনযাপনে বিশৃঙ্খলা না আনিলে নেতা নিজের ওজন বুঝাইতে পারেন না। মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করিবার পূর্বেই এক কিশোরী বুঝিল, ভারতে নাগরিকের মূল্য কত সামান্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy