—ফাইল চিত্র।
রাজনীতিতে মতভেদ কোনও নতুন বিষয় নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা বরং। রাজনৈতিক ময়দানে বিভিন্ন দল থাকবে, তাদের পরস্পর বিরোধী মতামত থাকবে, এই দৃশ্যই পরিচিত যে কোনও গণতন্ত্রে। কিন্তু আদর্শ বা নীতির ফারাক যতই থাক, সব রাজনৈতিক সংগঠনই শৃঙ্খলার প্রশ্নে কম-বেশি একই অবস্থানে থাকে। দলে বা সংগঠনে থাকতে হলে দলীয় নীতি-আদর্শই শিরোধার্য করে চলতে হবে, নীতি-আদর্শ-কার্যপ্রণালী নিয়ে প্রশ্ন থাকলে দলের ভিতরে সে বিষয়ে মুখ খুলতে হবে, বাইরে নয়— শৃঙ্খলার মূল কথা এই। সাধারণ কর্মী থেকে দলের শীর্ষ পদাধিকারী, সকলের জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য, কেউই শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে নন। পদ যত উঁচু হয়, দায়বদ্ধতা ততই বৃদ্ধি পায় বরং। এ কথাটা সম্ভবত মনে রাখতে পারেননি বোলপুরের তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপম হাজরার নানা মন্তব্য বার বার অস্বস্তি ডেকেছে তাঁর দল তৃণমূলের জন্য। সাম্প্রতিক নয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে সে পরম্পরা। কখনও রাজ্য প্রশাসনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি, কখনও নিজের দলের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কখনও তাঁর নিশানা হয়ে উঠেছেন তৃণমূলের কোনও নামজাদা নেতা। শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, তার বাইরের পরিসরেও অনুপম হাজরার কার্যকলাপ তার দলের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে একাধিক অবকাশে। কখনও মুকুল রায়ের সঙ্গে তাঁর রেলসফর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কখনও তাঁর বিজেপি ঘনিষ্ঠতার গুঞ্জন তাঁর দলের রক্তচাপ বাড়িয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতাজির সঙ্গে গাঁধীজির সম্পর্কে এক অবান্তর তুলনা টানা, সে প্রসঙ্গে মহাত্মা গাঁধী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করা, এমনকী নাথুরাম গডসের প্রতিও ঈষৎ সহানুভূতির আভাস দেওয়া।
মহাত্মা গাঁধী বা নাথুরাম গডসে সম্পর্কে অনুপম হাজরার যে মূল্যায়ণ প্রকাশ পেয়েছে, তৃণমূলের অবস্থান তার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। ব্যক্তি অনুপম হাজরার মতামত বা বিশ্বাস হয়ত যা-ই হোক, তৃণমূল নেতা তথা সাংসদ অনুপম হাজরা জনপরিসরে বা সামাজিক মাধ্যমে গাঁধী বা গডসে সম্পর্কে ওই মূল্যায়ণ প্রকাশ করতে পারেন না অতএব। প্রথমত, গাঁধীজি বা গডসে সম্পর্কে দলের মতামত কী, সে কথা অনুপম হাজরার জানা উচিত। দ্বিতীয়ত, দলীয় অবস্থানের পক্ষে মুখ খুলতে পারুন বা না পারুন, বিপক্ষে যে মুখ খোলা যায় না, তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচিত সাংসদের সে কথা বোঝা উচিত। তৃতীয়ত, একান্তই যদি মুখ বন্ধ রাখা না যায়, তা হলে দলের সংস্রব ত্যাগ করে দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে মুখ খোলা উচিত।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
অনুপম হাজরা এ সব যুক্তি-তর্ক বা বিচার-বিশ্লেষণের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেছেন বলে মনে হয় না। বার বার তিনি দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন, বার বার তাঁকে ঘিরে বিতর্ক হয়েছে, বার বার দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে অনুপম হাজরার বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ এত দিন পর্যন্ত তাঁর দল করেনি। ঈষৎ প্রশ্রয়ের আভাসই মিলেছে বরং। অনুপম হাজরা কিছুতেই থামছেন না দেখে অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করল দল। তাতেই ফের সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ হলেন বোলপুরের সাংসদ। ‘দিদি’র আদর্শে বিশ্বাস রেখে তা হলে কী লাভ হল, এমন অভিমানী প্রশ্নও তুললেন।
আরও পড়ুন
আজ দম্ভ দেখালে কাল ভারতী হবেন, ফেসবুকে অনুপম
তৃণমূলের নীতি-আদর্শ ঠিক না ভুল, সে নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। অনুপম হাজরার বিশ্বাস-মতামত ঠিক না ভুল সে নিয়েও চর্চা হতেই পারে। কিন্তু যত দিন তৃণমূলের ছাতার তলায় রয়েছেন অনুপম হাজরা, তত দিন তৃণমূলের অবস্থানই যে তাঁর অবস্থান, সে কথা অনুপম হাজরাকে মাথায় রাখতেই হবে। কিন্তু সাংসদ পারেননি। বার বারই প্রকাশ্যে এনেছেন দলের সঙ্গে নিজের সংঘাত।
ভারতের রাজনীতিতে অন্তর্দলীয় কোন্দল বা মতবিরোধ কোনও অপরিচিত দৃশ্য নয়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোন্দল বা বিরোধ যে স্বাস্থ্যকরও নয়, সে কথাও বোঝা দরকার। অনুপম হাজরা নীতির কথা বলছেন। বলছেন নৈতিকতার সঙ্গে আপস করতে পারবেন না। যে দলের প্রতীকে তিনি নির্বাচন জিতে সাংসদ হয়েছেন, সেই দলের রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখতে না পারাটা কী খুব নৈতিকতার নিদর্শন বহন করছে? অনুপম হাজরাকে এ প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে তা হলে। ধরে নেওয়া যাক, দলের সঙ্গে তার অনেক কিছুই যে মিলবে না, তা আগে বুঝতে পারেননি অনুপম হাজরা। এখন বুঝতে পারছেন। সে ক্ষেত্রে সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে দল ছেড়ে দেওয়ার রাস্তা তো খোলা। বোলপুরের সাংসদ সে পথ দেখে নিতেই পারতেন। কিন্তু সে পথে না হেঁটে, সাংসদ পদ এবং দলীয় সদস্যতা আঁকড়ে থেকে প্রকাশ্যে দলের অস্বস্তি বাড়াতে থাকা কি খুব নৈতিকতার পরিচায়ক হচ্ছে?
এত কাণ্ডের পরে যদি পদক্ষেপ করে দল, যদি শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মাথার উপরে, তা হলে অভিমানের কি আর কোনও অবকাশ থাকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy