Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ওরা বাধ্য, তাই বধ্য
Cheetah

প্রকৃতি নিয়ে খেলার জেরেই এই দেশ থেকে শেষ হয়েছে চিতা

‘‘তখন সিংহ খুঁজছি। গিয়ে দেখি, বিরাট কিছু ঘুমোচ্ছে। ফায়ার করতে ছ’টা চিতা উঠে বসল। বুড়ো শিকারি হাঁক পাড়ল, ঘোড়ায় বসুন সাহিব। চিতাদের আমরাই বর্শা ছুড়ে মেরে ফেলি।’’খবর ছুটল, তিন-তিনটে চিতা মেরেছেন রাজা রামানুজ প্রতাপ সিংহ দেও। আশপাশের গ্রামে যেন উৎসব লেগে গেল।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:৫০
Share: Save:

সালটা ১৯৪৭। স্বাধীনতা লাভের কিছু পরের ঘটনা। ছত্তীসগঢ়ের সরগুজা জেলা তখন মধ্যপ্রদেশে। ঝোপজঙ্গলে ভরা। সেখানে রামগড় গ্রামের কাছে এক রাতে নির্জনতা হঠাৎ খানখান হয়ে গেল মোটরগাড়ির ঘড়ঘড়ে। খানিক পরেই আকাশবাতাস কেঁপে উঠল পর পর গুলির শব্দে। খবর ছুটল, তিন-তিনটে চিতা মেরেছেন রাজা রামানুজ প্রতাপ সিংহ দেও। আশপাশের গ্রামে যেন উৎসব লেগে গেল। ‘তিন ভাই’ পর পর শুয়ে, কাছেই দাঁড়িয়ে রাইফেলধারী মহারাজাধিরাজ— ছবি তুলে রাখলেন রাজার সচিব। এক কপি ছবি-সহ খবরটি পাঠালেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’-র ম্যাগাজিন দফতরে। পত্রিকা দফতর উত্তর দিয়েছিল, জঘন্য কাজ হিসেবে রেকর্ডবইয়ে অবশ্যই লিখে রাখা যেতে পারে।

সেই দলিল অনুসারে, ওই তিন ভাইকে মারার পরই ভারত থেকে চিতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সরগুজাবাসীরা বলেন, একটি চিতা মানুষখেকো হয়ে গিয়েছিল, তাই বন্দুকে টোটা ভরেছিলেন প্রজাদরদি রাজামশাই। কিন্তু তিনটি চিতাকেই কেন মারতে হল, সে প্রশ্ন তাঁর বংশধরেরা এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, এর পরেও বছর কুড়ি তাঁরা রাজ্যের ইতিউতি চিতা দেখেছেন। তাদের একটি গর্ভবতী ছিল। অর্থাৎ, রাজার বুলেটে চিতাবংশ লোপাট হয়নি। ওড়িশায় ঢেঙ্কানলের জঙ্গলে ১৯৬০ সালে এক শিকারি নাকি ফের চিতা মারেন। ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশ সীমান্তে ১৯৫১-য় ও চিত্তুরের চন্দ্রগিরিতে ’৫২-র মার্চ মাসে চিতার দেখা মিলেছিল। ’৫২-তেই সরকারি ঘোষণা হয়, চিতা প্রাণীটি ভারত থেকে অবলুপ্ত। বিশেষ কারণ ছাড়া দেশে শিকার নিষিদ্ধ হয় তারও বছর কুড়ি বাদে। প্রসঙ্গত, সর্বোচ্চ বাঘশিকারের রেকর্ডটিও নাকি সরগুজার কোরিয়া রাজ্যের এই মহারাজারই দখলে। প্রায় ১,৭১০টি বাঘ মেরেছিলেন তিনি।

তবে চিতা বিলোপের জন্য তাঁকে দুষে লাভ নেই। তিনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা রাজধর্ম পালন করেছেনমাত্র। মহার্ঘ ‘এশিয়ান চিতা’ যে ভারত থেকে মুছে গেল, তার মূল কারণ শুধুই ঘাসবন উজাড় করে ফেলা নয়। রাজারাজড়ারা— সূর্যবংশ, চন্দ্রবংশ, মোগল, মরাঠা, রাজপুত, ব্রিটিশরাজ নির্বিশেষে চিতাগুলোকে যথেচ্ছ ধরপাকড় করেছেন, বর্শা-বন্দুক গেঁথে জঙ্গল থেকে তুলে এনেছেন। বাঘা কুকুরকে থাবড়ে-চাপড়ে অরুচি ধরলে চিতার গলায় বকলস গলিয়ে গোঁফে তা দিয়েছেন। তাদের দিয়ে শিকার ধরিয়েছেন। এই প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণের জেরেই চিতারা ভারত থেকে উবে গিয়েছে।

২৫০০-২৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকেই ভারতে চিতার উল্লেখ মেলে। পঞ্জাব, রাজপুতানা, লখনউ-আগরা সমেত উত্তর ভারত, মধ্যপ্রদেশ, দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অংশে, এমনকি বঙ্গভূমেও ছুটে বেড়াত চিতা। ঝোপঝাড়, কাঁটাগুল্মের ফাঁক থেকে হঠাৎ ছিটকে বেরোত। ফাঁকা জমিতেও তিরবেগে ছুটে চলে যেত। খোলা জায়গায় ঘুরত, তাই ফাঁদে ধরা ছিল সহজ। মস্তির মরসুমে বনে ঘোড়া ছুটিয়ে চিতাদের হা-ক্লান্ত করা হত। যখন ওরা হাঁপাচ্ছে তখন চোখে ডালপাতা খুঁচিয়ে দিশেহারা করে ঘাড়ের উপর চারপাই ফেলে আটকানো হত। পূর্ণবয়স্ক বনের চিতাও মাস ছয়েকেই কুকুর-বেড়ালের মতোই পোষ মেনে যেত। এত মানুষ-ন্যাওটা হয়ে পড়ত যে, নতুন লোকের সামনেও মেজাজ দেখাত না। এদের পোষ মানাবার সবচেয়ে পুরনো উল্লেখ আছে দ্বাদশ শতাব্দীর কল্যাণীরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের দরবারি রোজনামচা মানসোল্লাস-এ। ‘কোর্সিং’ বা ‘শিকার তাড়া করার খেলা’-য় চিতার কদর ছিল মারাত্মক। মধ্যযুগীয় ভারতে রাজঘরানার প্রিয় অবসর বিনোদন ছিল এই ‘কোর্সিং’। জঙ্গলের যেখানে কৃষ্ণসার, চিতল, গাজলা হরিণ মেলে, সেখানে চিতাদের ছেড়ে দেওয়া হত। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় পশুটি শিকারের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনছে দেখে বন্য উত্তেজনায় হইহই করে উঠতেন বাদশারা। অত্যন্ত দ্রুতগামী কৃষ্ণসার হরিণ মারতে চিতাই ছিল বাজি। শিকার ধরে মানুষদের কাছেই ফিরে আসত বিশ্বস্ত পশু। বনে পালাত না। মুখে হরিণটা ঝুলছে, সেই অবস্থাতেই মাথায় ঘোমটা (চিতার আলাদা রাজবেশও ছিল) পরিয়ে আবার তার গলায় শিকলি আটকানো হত। অনুগত চিতা জানত, কৃষ্ণসারের মাংস খানিকটা তারও জুটবে।

এতে কৃষ্ণসারের কী করে ‘একে একে নিবিছে দেউটি’ বোঝা গেল ঠিকই, কিন্তু চিতারা এত আদরেও টিকল না কেন? তার কারণ, পোষা চিতাদের বংশবৃদ্ধি হত না। চিতাদের স্বভাব অনুযায়ী, তাদের বনে না ছাড়লে বংশবিস্তার করতে পারে না। তাদের ভাব-ভালবাসার ধরন, জিন মিলমিশের নকশাটাই আলাদা। পুরুষ চিতারা মিলে মেয়ে চিতাকে অনেক ক্ষণ ধাওয়া করবে, তবে তার ডিম্বাশয়ের হরমোন জাগবে। চিতাদের ঘরে শিশুমৃত্যুও সাঙ্ঘাতিক।

বাড়ির চিতাদের ছেলেপিলে হত না বলে ক্রীড়ামোদী সম্রাটরা বন-জঙ্গল চেঁছেপুঁছে নতুন চিতা বেঁধে আনতেন। অনুপ সিংহ বড়গুজর বলে এক রাজপুতকে আকবরের সভায় ধরে আনা হয়েছিল। কারণ সে হরিণ ভেবে ছররা ছুড়ে বাদশাহের চিতাকে মেরে ফেলেছিল। আকবর তাকে শাস্তির বদলে চাকরি দিয়েছিলেন। শাহেনশাহের মনে হয়েছিল, যে লোক চিতার গতির প্রাণীকে মারতে পারে, তার দারুণ এলেম। ৪৯ বছরের রাজত্বকাল জুড়ে আকবরের পশুশালে প্রায় ৯,০০০ চিতা ছিল। তাই, অনুপ সিংহের মতো নিশানাবাজই দুষ্প্রাপ্য। এই ৯,০০০ চিতার মধ্যে চিতাশাবক জন্মেছিল এক বারই। সে এমনই বিরল, তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে পুত্র জাহাঙ্গির তুজ়ুক-ই-জাহাঙ্গিরি-তে তার বিধিসম্মত উল্লেখ করেছেন। সেই ১৬১৩ সালের পর আবার জঙ্গলের বাইরে বন্দিদশায় চিতাশাবকের জন্মের নথি মিলেছে ১৯৫৬-য়, ফিলাডেলফিয়ার চিড়িয়াখানায়!

আঠেরো শতকের মধ্যেই দেশের জঙ্গলে চিতার সংখ্যা হুহু করে নেমে গিয়েছিল। এ সময়ের ছবিগুলোয় অবশ্য প্রচুর চিতা। তারা গরুর গাড়িতে চেপে সেজেগুজে খেলার ময়দানে চলেছে। হুজুরের খাসমহলে খাটিয়ার উপর বসে আছে। ওদের জন্য খাঁচাও লাগত না। খাটিয়ার পায়ার সঙ্গে বাঁধা থাকত, হাত থেকেই মাখন চেটে খেত। অওধে মুরগির মতো চিতাদেরও লড়াই হত। ১৮৯৬-এ বাজারগুলোয় চিতার ছানার দর শুরু হত ১০ টাকা থেকে। ১৮৪০-এ ট্রেনিং দেওয়া চিতা বিকোত ১৫০-২৫০ টাকায়।

ইংরেজদের শিকারকাহিনিগুলিতে চিতার বৃত্তান্ত বেশ কম। আসলে ব্রিটিশরা যখন এ দেশে বন্দুক পিঠে ঘুরছে, তখন চিতা আর কই? সে সময় কিন্তু ভালই জঙ্গল ছিল, চিতার খাদ্যও ছিল পর্যাপ্ত। তবুও ১৭৭২ সালের পর থেকে বিশ শতক পর্যন্ত ভারতে মোটে ৪১৪টা চিতার লিখিত রেকর্ড মিলেছে। এ সময়েই আবার ২০০টা চিতা মারা পড়েছে ছাগল-চরিয়েদের হাতে। আরও অনেকেই তত দিনে পাপোশ কিংবা শীতের কোট। যারা বেঁচে ছিল, শ্বাপদমহলে তাদের আর মানইজ্জত বাকি ছিল না। ১৮৭৮ সালে ক‌র্নেল ই এ হার্ডি আওয়ার হর্সেস-এ লিখেছেন, ‘‘তখন সিংহ খুঁজছি। বুড়ো ভারতীয় শিকারি বলল, চার মাইল দূরে বড় জন্তু আছে। গিয়ে দেখি, বিরাট কিছু ঘুমোচ্ছে। ফায়ার করতে ছ’টা চিতা উঠে বসল। বুড়ো হাঁক পাড়ল, ঘোড়ায় বসুন সাহিব। চিতাদের তো আমরাই বর্শা ছুড়ে মেরে ফেলি।’’

১৮৮০ সালে এক চিতা ‘কোর্সিং’ খেলার সময় বিশাখাপত্তনমের গভর্নরের এজেন্ট ও বি আরভাইনকে আক্রমণ করে বসে। ক্ষতবিক্ষত আরভাইন মারা যান। ব্যতিক্রমী দুর্ঘটনা হলেও তার পর ব্রিটিশরা ভারতীয় পশুটিকে ‘শয়তান’ বলে দাগিয়ে দেয়। চিতা মারলেই পুরস্কার ঘোষণা করে।

এতেই চিতাদের খেল একেবারে খতম হয়ে যায়। তার পর থেকে টিপু সুলতানের শিকার-তাঁবুর ছবিতে, দ্বিতীয় শাহ আলমের দেওয়ালচিত্রেই ভারতীয় চিতাদের চিনেছি। আর ইদানীং ওদের গুলিয়েছি লেপার্ড অর্থাৎ চিতাবাঘের সঙ্গে। চিতা আর চিতাবাঘ সম্পূর্ণ আলাদা প্রাণী। লেপার্ডের গায়ে ফুলের মতো ছোপ। চিতার গায়ের চকরাবকরাগুলো বলায়াকৃতি, ছিপছিপে চেহারা, লম্বাটে পা, তুলনায় ছোট মাথা। মুখে কান্নার মতো দাগ। ভারতে নির্বংশ হওয়ার পর, এদের ‘এশিয়ান চিতা’ নামে ‘আফ্রিকান চিতা’-র চেয়ে আলাদা করা হয়। শেষ খবর, বিশ্বে শুধু ইরানে ৫০টা এশিয়ান চিতা অবশিষ্ট আছে।

এক দশক ধরে কথা চলছে, চিতাদের ভারতে ফেরানো হবে। দেশে আসবে এশিয়ান চিতার জাতভাই আফ্রিকান চিতা। ফ্যারাওদের পোষ্যের শখ মেটাতে গিয়ে তারাও আজ সঙ্কটাপন্ন। তবু, বছর শুরুতেই সুপ্রিম কোর্ট প্রকল্পটিতে সায় দিয়েছে, আর বছর শেষের মুখে বিশেষজ্ঞেরা মধ্যপ্রদেশে জঙ্গল পর্যবেক্ষণ করে দেখছেন চিতার জন্য পরিবেশটি কেমন। ৪ ডিসেম্বর ছিল বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ দিবস ও বিশ্ব চিতা দিবস। করোনারাজত্বে দিনটিতে প্রকৃতি ও পশুপাখির প্রতি অবিচার নিয়ে বিতর্ক জমল। মানুষ ও পশুরাজ্যের সাক্ষাৎ ও সংঘাত, চিতা পুনর্বাসনে আবশ্যক শর্ত— সব প্রসঙ্গই উঠল। এ সব আলোচনা কাজে পরিণত হলে ভারতের ‘চিতা প্রত্যাবর্তন প্রকল্পটি’-ও তেজী হবে।

তখন একমাত্র ভারতে— পৃথিবীর ৮টি ‘বিগ ক্যাট’-এর ৬টি মিলবে আবার। বাঘ, সিংহ, লেপার্ড, স্নো-লেপার্ড, প্যান্থার আর চিতা। শেষেরটি স্থলজদের মধ্যে দ্রুততম। তিন সেকেন্ডে ১০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা গতি তুলতে পারে। অবশ্য, দুর্ভাগ্য জিনিসটা তাদের চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগামী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cheetah Leopard Wildlife habitat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE