Advertisement
E-Paper

বর্ণহীন সবুজ চিন্তা

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শব্দটি যে এখন কতখানি অলীক, ‘পদ্মাবতী’ নামক চলচ্চিত্রটিকে কেন্দ্র করিয়া জমিয়া উঠা কুনাট্য তাহার প্রমাণ।

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৭ ০১:১৭

ছয় দশক পূর্বে, ১৯৫৭ সালে, ভাষাবিদ নোম চমস্কির বই ‘সিনট্যাকটিক স্ট্রাকচারস’ প্রকাশিত হইয়াছিল। তাহাতে একটি বাক্য ছিল, যাহার বঙ্গানুবাদ করিলে দাঁড়ায় ‘বর্ণহীন সবুজ চিন্তারা ঘুমায় সরোষে’ (অনুবাদ: নিমাই চট্টোপাধ্যায়, ‘বাতিল জঞ্জাল’)। ‘অবৈধ বাক্য’ কাহাকে বলে, তাহার উদাহরণ হিসাবে ব্যবহৃত বাক্যটি কালেক্রমে প্রবাদে পরিণত হইয়াছে। চমস্কির বক্তব্য ছিল, ব্যকরণগত ভাবে শুদ্ধ হইলেই কোনও বাক্য ‘বৈধ’ হয় না, বৈধতার জরুরি শর্ত অর্থপূর্ণতা। সবুজ রং বর্ণহীন হইতে পারে না, চিন্তার রং থাকে না, চিন্তারা ঘুমাইতে পারে না এবং সরোষে ঘুমানো অসম্ভব। বাক্যটির প্রতিটি শব্দই অন্য কোনও না কোনও শব্দের বৈধতা হরণ করে। কেহ বলিতেই পারেন, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় অবৈধ বাক্য বস্তুটি এক নূতন মাত্রা পাইয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর অধিকাংশ কথাই— শুধু ব্যকরণগত ভাবে শুদ্ধ নহে— অতি শ্রুতিমধুর এবং শুভবুদ্ধির ছটায় বিভাসিত। কিন্তু, বাক্যগুলি অবৈধ, কারণ তাহা অর্থপূর্ণ নহে। উদাহরণস্বরূপ জাতীয় সংবাদমাধ্যম দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনিলেই এই অর্থহীনতা স্পষ্ট হইবে। তিনি বলিয়াছেন, ‘তাঁহার সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সমস্ত রকম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ’। তিনি ভুলিয়াছেন, গত সাড়ে তিন বৎসরের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট, একই বাক্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দায়বদ্ধতার সহিত তাঁহার সরকারের সহাবস্থান আর কোনও বোধগম্য অর্থ বহন করে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করাই তাঁহার সরকারের, তাঁহার জমানার, অভিজ্ঞান। গালভরা কথাটি শুনিতে মন্দ লাগে না। কিন্তু, যে জমানায় গৌরী লঙ্কেশদের বেঘোরে প্রাণ হারাইতে হয়, শাসক দলের বিরুদ্ধে কলম ধরিলেই শত কোটি টাকার মানহানির মামলার মুখে পড়িতে হয়, প্রবীণ সাংবাদিকের বাড়িতে ভোররাতে আয়কর হানা হয়, সেই জমানায় এই কথাগুলি শুধু অবৈধ নহে, অশালীনও বটে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শব্দটি যে এখন কতখানি অলীক, ‘পদ্মাবতী’ নামক চলচ্চিত্রটিকে কেন্দ্র করিয়া জমিয়া উঠা কুনাট্য তাহার প্রমাণ। চরিত্রটি আদৌ ঐতিহাসিক, না কি তাহার অস্তিত্ব শুধু লোকগাথায়, সেই প্রশ্নটিকে আপাতত সরাইয়া রাখা যাউক। কিন্তু, একটি ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেন্দ্র করিয়াও কেহ যদি একটি কাহিনি রচনা করেন, নিজের মতো করিয়া সেই চরিত্রটিকে ব্যাখ্যা করিয়া লন, তাঁহার সেই অধিকার কাড়িয়া লওয়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় তুমুল হস্তক্ষেপ। চলচ্চিত্রকার তথ্যচিত্র নির্মাণের দাবি করেন নাই, বায়োপিক বানাইবার কথাও বলেন নাই। সিনেমাটি নেহাতই কল্পকাহিনি— ইতিহাস-আশ্রিত, এইটুকুই যাহা। সেই আখ্যানের প্রতিবাদ করিবার স্বাধীনতাও প্রত্যেকের বিলক্ষণ আছে। কিন্তু, ছবিটিকে নিষিদ্ধ করিবার দাবি তুলিয়া, অথবা ভাঙচুর করিয়া, হুমকি দিয়া প্রতিবাদ হইতে পারে না। কর্তারা বলিতে পারেন, যাহারা এই অশান্তি পাকাইতেছে, তাহারা নেহাতই বিচ্ছিন্ন শক্তি, যাহাকে ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্টস’ বলে। কিন্তু, প্রাদেশিক অস্মিতার জিগির তুলিয়া এমন অশান্তি পাকানো ইদানীং সহজ হইয়াছে কেন, এই প্রশ্নটি থাকিবে। এবং, তাহার উত্তরও থাকিবে— মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এই জমানায় এখন এত সহজে খর্ব করা যায় যে তাহা কার্যত স্বাভাবিক হইয়াছে। অন্য প্রশ্নও থাকিবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলির প্রতি কঠোর হইতেছে না কেন? চলচ্চিত্রটিকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইতেছে না কেন? যোগী আদিত্যনাথ কেন ছবিটির মুক্তির বিরুদ্ধে সওয়াল করিতেছেন? সব প্রশ্নের উত্তরই জানা। বক্তৃতায় যাহাই বলুন, নরেন্দ্র মোদীর নিকট মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কথাটি অর্থহীন। ফলে, তাহাকে রক্ষার প্রতিশ্রুতিটি অবৈধ। বর্ণহীন সবুজ চিন্তার ন্যায়।

Freedom of expression Government Punishment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy