Advertisement
E-Paper

রসগোল্লা আর রিফিউজি

তবে রসগোল্লা নিয়ে গোলমাল কম নয়। পরীক্ষায় শূন্য পেলে বলা হয় ‘রসগোল্লা’ পেয়েছে। ভীষণ ভাল নম্বর পেলে সেই রসগোল্লাই লোকজনকে ডেকে খাওয়ানো হয়।

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০

এখানেও কিন্তু সেই রামচন্দ্র বিরাজমান। বাল্মীকি রামায়ণের এক ভাষ্য ‘দণ্ডি রামায়ণ’–এ নাকি রসগোল্লার কথা রয়েছে। ওডিশায় বলরাম, জগন্নাথ, সুভদ্রাদের সঙ্গে রসগোল্লার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেলেও, এ ক্ষেত্রে বাঙালি খুব আত্মসংযম দেখিয়েছে। দেবদেবীর শরণ নেয়নি। কে সি দাসদের ওপরই ভরসা রেখেছে। এই মুহূর্তে গোটা বাংলা ‘জিআই’ পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত। বেশ কিছু দিন ধরে এই জল্পনা চলছিল, কিন্তু তাতে রসগোল্লার বিক্রি কম বা বেশি কিছু হয়নি। রসগোল্লা নিজে কখনও ‘আমার জন্ম কোথায়’ বলে মেগাসিরিয়ালের নায়কের মতো কৌতূহলী হয়ে উঠবে— সেই সুযোগ পায়নি।

তবে রসগোল্লা নিয়ে গোলমাল কম নয়। পরীক্ষায় শূন্য পেলে বলা হয় ‘রসগোল্লা’ পেয়েছে। ভীষণ ভাল নম্বর পেলে সেই রসগোল্লাই লোকজনকে ডেকে খাওয়ানো হয়। আবার কুসংস্কারে বিশ্বাসীরা পরীক্ষার আগে কিছুতেই রসগোল্লা খেতে দেবে না, তা হলে নাকি ফলাফলে সেই রসগোল্লাই ফিরে আসবে। মানুষের জীবনে পরীক্ষা আর রসগোল্লার এই টানাপড়েনের গুচ্ছের নিদর্শন বাঙালি দেখে এসেছে। এ বার রসগোল্লার ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে টানাটানি করতে করতে, অন্যদের টেক্কা দিয়ে পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার মতোই, জিআই তকমা পেয়ে বাংলা ঘোষণা করতে পারল, রসগোল্লা তারই, আর কারও নয়।

আসলে ওই ফুলগাছটা আমার বাগানে গজিয়েছে না দু’ইঞ্চি পাশে প্রতিবেশীর জমিতে, তাই নিয়ে কাজিয়া হয় বছরভর। পাশের ফ্ল্যাটের ছেলে পরীক্ষায় বেশি পেলে রাতে রান্না চড়ে না নিজের ঘরে। অন্য কারও ভাল হয়েছে শুনলে মনের ভিতরে বঙ্গোপসাগরীয় নিম্নচাপ ঘনিয়ে ওঠে যে প্রবণতা মেনে, তারই সহোদর: সন্ধের খবর দেখার সময় রসগোল্লায় জিতে ডায়াবিটিসের রোগী বাঙালিরও ‘দিয়েছি ওডিশাকে একদম সপাটে’ উল্লাস। কাল যদি আবার এই রাজ্যেরই সব ক’টা জেলা ‘রসগোল্লা কার?’ বলে নিজের নিজের জেলার দাবিতে জিআই পাওয়ার জন্য মাঠে নামে, তা হলে ওডিশার ব্যাপারটা অতীতে বা ডকে তুলে, জেলায় জেলায় তুলকালাম। তখন পুরুলিয়া হাওড়াকে দুয়ো দেবে, মেদিনীপুরকে টিটকিরি দেবে কলকাতা।

আসলে বাঙালি কিচ্ছু না পেতে পেতে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে, এখন সে যে কোনও ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টায় হামলে পড়ে। ট্রফি একটা পেলেই হল, তা যা কিছুর জন্য হোক— রসগোল্লা বা শ্যামাপোকা। এই হামলে পড়ায় প্রকাণ্ড ধুয়ো দেয় মিডিয়াও, কারণ তার তো প্রতি সন্ধেয় একটা হল্লা চাই, নারদ-নারদ চাই। ব্যাপার হল, একটা ‘বনাম’ নইলে আমাদের জীবন জমে না। আমি মজা পাব এটা যথেষ্ট নয়, অন্য কেউ বেশ হেরে গেল, পড়ে গেল, সেটা আমার উত্তেজনার পক্ষে জরুরি। ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখতে বসে দুটো অচেনা দলের মধ্যে একটাকে তাই প্রথমেই সমর্থন শুরু করি। আবার আমার প্রিয় পরিচালক খুব ভাল— এটুকু বলে থেমে থাকি না, অন্যের প্রিয় পরিচালক যে বেশ খারাপ, ফাঁকেতালে পুরস্কারগুলো বাগিয়ে নিয়েছে, সেই মশলা ছড়িয়ে তবে তর্কের জয়টা উপভোগ করি। আচ্ছা, এখানে যখন রসগোল্লা নিয়ে বিজয় উৎসব চলছে, তখন ওডিশায় কেউ কি অনশনে বসেছে? নিদেনপক্ষে গ্লানিতে রসগোল্লা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করেছে? বাংলায় আর কক্ষনও বেড়াতে যাবে না প্রতিজ্ঞা করেছে? যদি কেউ তা করত, তা হলে এতক্ষণে তাকে ‘প্রাদেশিক’ বলে চিহ্নিত করা হত। তা হলে ওডিশাকে হারিয়ে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে বুক ঠুকে বক্তৃতা কপচানো বাঙালিও কি সমান প্রাদেশিক নয়?

রসগোল্লার বয়স বাড়বে, জন্ম বা পিতৃপরিচয় তার ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। দেশ থেকে বিদেশ হয়ে অনেক দূর পাড়ি জমাবে সে। খাদ্যাভাস বদলে গেলেও মিউজিয়ামে ঠাঁই পাবে। রসিকমাত্রেই বুঝবে, পাখি বা বনরাজির মতো, রসগোল্লারও কোনও সীমানা হয় না। নতুন করে জিআই না হয় পেলই রসগোল্লা— সে তো একই উপকরণে দিনের দিন তৈরি হবে আর তার পর জিভের সুখ করে গলা বেয়ে নামবে নীচে। কিন্তু এমন অনেক কিছু অনেক আগে থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিল, আমাদের সম্পদ হয়ে চিহ্নিত ছিল, যা সম্পর্কে উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই দেখাইনি আমরা। গাছের পর গাছ কাটা পড়েছে, বহু প্রজাতির পাখি অবলুপ্ত। রয়াল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা নিয়ে মাঝেমধ্যেই কপালে চিন্তার ভাঁজ জমে। শিশু পাচার বা অনাহারে মৃত মানুষের তালিকায় দেশের বা রাজ্যের নাম প্রথমে এলে, তা নিয়ে যথাসম্ভব কম আলোচনা করে, ব্যাপারটাকে চেপেচুপে সে ট্যাগ ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলে আমরা বাঁচি।

আরে ভাই পৃথিবীর সবকটা রিফিউজির অমন একটা করে জিয়োগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন আছে। ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

refugees geographical indications
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy