Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কিছু বেদনা কিছু ইস্পাত

বিপুল চক্রবর্তীর তেজস্বী লিরিক পড়া যায় ‘তোমার মারের পালা শেষ হলে’ কবিতাটিতে। শত নির্যাতন বিপুলকে স্তব্ধ-স্তিমিত করতে পারেনি।

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৭ ১৩:৩৭
Share: Save:

অনেক কাব্যতত্ত্ববিদ আছেন, যাঁরা ‘কমিটেড পোয়েট্রি’ বা অঙ্গীকারবদ্ধ কবিতার কথা শুনেই অস্বস্তি বোধ করেন এবং সজোরে ভুরু কোঁচকান। তাঁরা মনে করেন, এই কাব্য ‘পিয়োর পোয়েট্রি’ বা বিশুদ্ধ কবিতা নয়। কারণ অঙ্গীকারের হাত ধরেই আসে স্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য এবং অচিরেই কবিতা পরিণত হয় স্লোগান-সর্বস্বতায়। তাঁরা হয়তো নকশাল আন্দোলনের এই পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা বইটি (সংকলন ও সম্পাদনা: রাহুল পুরকায়স্থ, ধানসিড়ি প্রকাশন) হাতে তুলে নিলে, ১৮২ জন কবির লেখা ২৮০টি কবিতা পড়লে, বিস্ময়ে ও মুগ্ধতায় মত বদলাবেন।

কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ অনায়াসে স্লোগানকে নিয়ে আসেন কবিতার নিবিড় কিন্তু স্পষ্টবাদী প্রাঙ্গণে। লেখেন, ‘আমাদের জন্মে শুধু অবিরাম শোষণের গ্লানি/ এখন সময় নেই চপল ছায়ায় বসে গল্পের আসর/ এখন সময় নেই পান করি অসহায় চরিত্রের মদ;/ তীক্ষ্ণ বুলেটের মুখে বস্তুত এখন প্রয়োজন/ শ্রেণিশত্রু নিধনের কঠিন কঠোর এক দৃঢ় সংগঠন।’ বিপ্লবী ও কবি দ্রোণাচার্য ২৪ মাঘ, ১৩৭৮ সালে হুগলি জেলে নিহত হন।

মুরারি মুখোপাধ্যায়, তিমিরবরণ সিংহ, বিপুল চক্রবর্তী-সহ অনেক বিপ্লবী কবিই দ্রোণাচার্যের পথসঙ্গী। মুরারি তাঁর ইস্পাতসম লিরিকে লিখেছেন ‘ভালোবেসে’ কবিতাটি। এক-এক স্তবকে চাঁদ, নদী, ফুল, পাখিকে সাজিয়ে উপসংহারে এই প্রচলিত চারটি কাব্যিক উপাদানকেই তিনি গেঁথেছেন জ্বলন্ত অভ্যুত্থানের সঙ্গে। চূড়ান্ত স্তবকটি পড়ে বোঝা যায়, তিনি ফুল ও পাখিকে যুক্ত করেছেন প্রতিশোধের অনিবার্য সততার সঙ্গে— ‘চাঁদ নদী ফুল তারা পাখী/ দেখা যাবে কিছুকাল পরে/ কেননা এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি/ এখন আগুন চাই আমাদের এই কুঁড়েঘরে।’ এই কবি ২৫ জুলাই, ১৯৭১-এ হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে শহিদ হন।

বিপুল চক্রবর্তীর তেজস্বী লিরিক পড়া যায় ‘তোমার মারের পালা শেষ হলে’ কবিতাটিতে। শত নির্যাতন বিপুলকে স্তব্ধ-স্তিমিত করতে পারেনি। বরং নিপীড়ন তাঁকে করে তুলেছে আরও সুদৃঢ়, সুকঠিন এবং তিনি পরিণত হতে চেয়েছেন একটি আহত, যন্ত্রণাদগ্ধ বাঘে, যে আজ কি কাল তার পাওনাগণ্ডা ঠিক বুঝে নেবে— ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাবুকের দাগ যেন থাকে/ এমন ভাবে মারো... এমন ভাবে মারো/ তোমার মারের পালা শেষ হলে/ আমাকে দেখায় যেন ডোরাকাটা বাঘের মতন।’

শুধুমাত্র পূর্ণশতাংশ বিপ্লবীরা নয়, যাঁদের নকশাল আন্দোলনের প্রতি প্রচ্ছন্ন দরদ ও সহানুভূতি ছিল, যাঁরা সমব্যথী ছিলেন এবং যাঁরা নকশাল-নিধনে মত্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, তাঁরাও অসামান্য ভারাক্রান্ত কবিতা লিখেছেন। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁদের কলমে তুলে এনেছেন বিষাদ ও ক্ষোভ। অনুচ্চ স্বরে, স্বল্প কথায় শঙ্খ ঘোষ তাঁর ও সতীর্থদের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন— ওদের অভিলাষ, লক্ষ্য এবং আদর্শের প্রতি আমাদের সহানুভূতি ছিল, শুধু ওদের প্রক্রিয়া ও কর্মপদ্ধতি আমরা মেনে নিতে পারিনি। এই দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থ রূপ পেয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রবাদপ্রতিম কবিতা ‘ছেলে গেছে বনে’-তে। আবার আপসহীন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন, ‘আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে/ ছিড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ/ ... আমার, যে আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা/ তোমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’

মাঝেমধ্যে বিপ্লবী ও সমব্যথী অ-বিপ্লবী কবিদের ভিতর গড়ে ওঠে আশ্চর্য সংলাপ, যেমনটি ঘটেছে এক দিকে বিপ্লবী তিমিরবরণ সিংহ ও অন্য দিকে শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে। ১৯৭১-এ বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে নিহত তিমিরবরণ ছিল শঙ্খ ও অলোকরঞ্জনের পরমপ্রিয় ছাত্র। গ্রামে যাওয়ার ঠিক আগে, গভীর রাত্রে, সে অলোকরঞ্জনকে বলে গিয়েছিল, ‘দেখবেন, বিপ্লব ঠিক আসছে’ এবং শঙ্খ ঘোষকে: ‘কোথায় যাব, কবে ফিরব, কিছু ঠিক নেই।’

এই ছাত্র তার চরম আত্মত্যাগকে আপাত-লঘুতার বিষয় করেছিল ‘ও পাগল’ কবিতায়— ‘ও পাগল, ও পথ তুই মাড়াসনে মাড়াসনে/ ও পাগল, পাগলামি তুই ছাড়/ ... বলতো/ শহিদ হওয়া কি আমাদের মানায়।’ তিমিরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শঙ্খ লিখেছিলেন, ‘ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়/ দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ/ তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?/ নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই/ তোমার ছিন্নশির, তিমির।’ তাকে ‘অমৃতধামযাত্রী’-র শিরোপা প্রদান করে অলোকরঞ্জন লেখেন, ‘আমি কার মৃত্যুরস আস্বাদন করি/ মনে-মনে/ ...যেদিন পরানো হল হাতকড়ি/ গানের খাতাটি তার দিয়ে গেছে আমাকে, গোপনে,/ ঠিক রাত দুটোর সময়/ সবকিছু দিলে যেন ভয়ানক চুরি করা হয়।’ তিন জনে মিলে রেখায়িত করেছেন এক তন্ময় ত্রিভুজ, একটি বেদনার্ত কোলাজ।

আরও বহু উদ্দীপিত ও বিয়োগান্ত কবিতা পড়তে পড়তে, ঘোর ‘স্লোগানবিরোধী’রও মনে আসবে লুই আরাগঁ-র উক্তি: ‘আই গো টু মাই ডেথ অ্যান্ড ও ফ্রেন্ডস ইউ উইল নো দ্য রিজন হোয়াই।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE