Advertisement
E-Paper

বিপজ্জনক

সে নাবাহিনীর মেজর নীতিন লিটুল গগৈ আর ছত্তীসগঢ়ের আইপিএস অফিসার এসআরপি কাল্লুরি। ভারত বলিতে এখন ঠিক কী বোঝায়, তাঁহারা সেই ধারণাটির প্রতীক।

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৭ ০০:২৫

সে নাবাহিনীর মেজর নীতিন লিটুল গগৈ আর ছত্তীসগঢ়ের আইপিএস অফিসার এসআরপি কাল্লুরি। ভারত বলিতে এখন ঠিক কী বোঝায়, তাঁহারা সেই ধারণাটির প্রতীক। আরও স্পষ্ট করিয়া বলিলে, রাষ্ট্র তাঁহাদের ‘কৃতিত্ব’কে যে ভাবে স্বীকৃতি দিতেছে, ভারতের ধারণাটি তাহাতেই প্রতিভাত। গগৈ কাশ্মীরের সেই অফিসার, যিনি এক নাগরিককে জিপের সামনে বাঁধিয়া রাস্তায় ঘুরাইয়াছিলেন। সেনাবাহিনীর দিকে পাথর ছুড়িবার শাস্তি। আর কাল্লুরি ছিলেন বস্তারের পুলিশপ্রধান— নন্দিনী সুন্দরের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের, বেলা ভাটিয়ার উপর আক্রমণ, তাঁহার বিরুদ্ধে জমিতে থাকা অভিযোগের ধাক্কায় সরকার শেষ অবধি তাঁহাকে বস্তার হইতে সরাইয়া দিতে বাধ্য হয়। অবশ্য, পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সময় লাগে নাই। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন’-এ ‘জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকতা’ বিষয়ক বক্তৃতা দিলেন কাল্লুরি— তাঁহার নিজের ভাষায়, দিল্লিতে তাঁহার অধ্যায়ের সূচনা হইল। নীতিন গগৈকে অবশ্য সরিতেও হয় নাই, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত। তাহার পরই, ‘বীরত্ব এবং নিজের দায়িত্বে অবিচলিত থাকিবার’ স্বীকৃতি হিসাবে সেনাপ্রধানের খেতাব পাইলেন তিনি। ঘটনা দুইটি পৃথক, কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা। সূত্রটি নরেন্দ্র মোদীর ভারতবর্ষের আত্মপরিচয়ের। গগৈ বা কাল্লুরি যে ভাবে গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তগুলিকেও লঙ্ঘন করিয়াছেন, এই দেশে তাহার শাস্তি হয় না তো বটেই, বরং তাঁহাদের স্বীকৃতি দিয়া রাষ্ট্র সেই লঙ্ঘনকে বৈধতা প্রদান করে। যেন বলিয়া দেয়, যাহা হইয়াছে, বেশ হইয়াছে। শাসক দলের সাংসদ যখন এক বিশিষ্ট লেখিকাকে জিপের সামনে বাঁধিয়া ঘুরাইবার কথা বলেন, তখনও তাহা সেই স্বীকৃতিই— জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়া সব আচরণ করিবার অধিকারই যে সেনার, ফলত রাষ্ট্রের, আছে, তাহা জানাইয়া দেওয়া।

ইহা গণতন্ত্রের পক্ষে গভীর উদ্বেগের। গণতন্ত্র একনায়ককে স্বীকৃতি দেয় না, ফলে যে কোনও পথে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করাই এই শাসনের ধর্ম। সে কাজে সেনাবাহিনী (এবং পুলিশ) শাসকের স্বাভাবিক হাতিয়ার। কাশ্মীরে বিক্ষোভকারীদের শাস্তি দেওয়ার, শাসন করিবার অধিকার যে সেনাবাহিনীর নাই, এই কথাটি ভুলাইয়া দিতে পারিলেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রশ্ন করিবার পরিসর থাকে না। বস্তারে মানবাধিকার কর্মীদের পথ রোধ করিতে পারিলেই আর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের প্রতিবাদ হয় না। জাতীয়তাবাদের জিগিরটি এই ক্ষেত্রে মস্ত সহায়ক। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যদিবা নীতিন গগৈয়ের আচরণ লইয়া দুই চারটি কথা হইত, দেশপ্রেমী বনাম রাষ্ট্রদ্রোহীর দ্বন্দ্বটি খাড়া করিবার ফলে সেই সম্ভাবনাও মারিয়া রাখা গিয়াছে। গণতন্ত্রের পক্ষ লইতে গিয়া রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা কুড়াইবার সাহস কম লোকেরই হয়।

কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া দেখাইয়া দিতেছে, জাতীয়তাবাদের এই দ্বন্দ্বটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে কতখানি মোক্ষম। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ গগৈয়ের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে টুইট করিয়া অভিনন্দন জানাইয়াছেন। যখন ঘটনাটি ঘটিয়াছিল তখন কংগ্রেসের নিন্দা এবং এখন অভিনন্দন— অবস্থানের এই পরিবর্তন অকারণ নহে। আকবর রোডও সম্ভবত হিসাব কষিয়া লইয়াছে, রাজনীতির ময়দানে দেশপ্রেমের গরম বুলি গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল অপেক্ষা অনেক বেশি হাততালি কুড়াইতে পারে। সেনাবাহিনীকে প্রশ্নাতীত উচ্চতায় ঠাঁই দেওয়ার, গণতন্ত্রের সীমারেখা লঙ্ঘনের অধিকার দেওয়া নরেন্দ্র মোদীতন্ত্রের পক্ষে অনুকূল; কংগ্রেসও সেই জলে হাত ধুইয়া লইতে মরিয়া। তাহার ফল গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক হইবে না তো বটেই, এমনকী সেনাবাহিনীর পক্ষেও নহে। সেনার উপর হইতে অসামরিক নিয়ন্ত্রণ সরিয়া গেলে কী হয়, কী হইতে পারে, উত্তর-ঔপনিবেশিক দুনিয়া তাহা অভিজ্ঞতায় জানে। ভারতও সেই পথে হাঁটিতেছে, আশঙ্কা থাকিয়াই যায়।

democracy rule nationalism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy