তিনি বলেছেন— “আমি যুদ্ধ চাই না। আমি শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। যুদ্ধ মানে আর্থিক, সামাজিক এবং অবশ্যই মানবসম্পদের ক্ষতি। যুদ্ধ ধ্বংস ডেকে আনে।” তিনি পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় নিহত সিআরপি জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরা।
তাঁর একটা প্রশ্নও রয়েছে, “কেন সে দিন এত অসতর্ক ভাবে বাহিনী স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল?’’ প্রশ্নটা জরুরি বলা ভাল খুবই জরুরি।
সদ্য নিহত বায়ুসেনা পাইলট নিনাদ মন্দাভগনের স্ত্রী বিজেতার একটা আর্জি আছে, “সোশ্যাল মিডিয়ার ‘যোদ্ধারা’ এ বার থামুন। আপনাদের ‘জোশ’ এত বেশি হলে সেনায় যোগ দিয়ে দেখুন কেমন লাগে। আর হ্যাঁ, আমরা যুদ্ধ চাই না”। ঠিক একই দিনে ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমদাবাদের গুলবার্গ সোসাইটি আবাসনে নৃশংস ভাবে নিহত ৭৩ বছরের এহসান জাফরির মেয়ে নিসরিন জাফরিও বলেছেন, “ঘৃণা ছড়ানো ও মানুষ মারার আগে একটু ভাবুন। সব ধর্মই শান্তির কথা শেখায়।” তাঁর মতে, গোধরার সময়ে সরকার শক্ত হাতে হাল ধরলে কয়েকশো নির্দোষ মানুষকে মরতে হত না। সম্প্রতি পুলওয়ামায় জঙ্গি-হানায় নিহত অধিকাংশ সি আর পি জওয়ানদের স্ত্রী এবং পরিবার স্পষ্ট ভাবে বলছেন, তাঁরা যুদ্ধ চান না। এবং ভারতীয় জওয়ানদের নিয়ে রাজনীতি করারও বিরোধী তাঁরা। কিছু দিন আগে সমগ্র ভারতবাসীর কাছে ঠিক এ রকমই একটি আবেদন রেখেছিলেন উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের হিংস্রতায় নিহত পুলিশ ইনস্পেক্টর সুবোধ কুমার সিংহের ছোট ছেলে অভিষেক সিংহ। তিনি বলেছিলেন “ভারতবাসীরা দয়া করে বুঝুন, এই গণপ্রহারের সংস্কৃতি দিয়ে, এই সাম্প্রদায়িক হিংসা দিয়ে কিছু অর্জন করা যাবে না। এমন দিন যেন না-আসে, যে দিন আমরা ভারতেই পরস্পরকে মারতে শুরু করব। পাকিস্তান, চিন কারও কিছু করার দরকারই পড়বে না।” না, তালিকা আর লম্বা করতে চাই না। কিন্তু, সমগ্র দেশবাসীর প্রতি যারা এই আবেদন রেখেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা মিল আছে, এঁদের প্রত্যেকের কারও স্বামী, কারও বাবা, কারও ছেলে বা কারও নিকটাত্মীয় যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা বা জঙ্গিদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এঁরা প্রত্যেকেই ভুক্তভোগী, দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন এঁদের এক সারিতে বসিয়েছে।
পরস্পর ভুক্তভোগী পরিবারগুলির সমস্ত দেশবাসী ও সরকারের প্রতি এই আবেদনগুলি ভারতের সামগ্রিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় এক একটি বিজ্ঞাপন হতে পারত, তা হয়নি। আবেদনগুলি ছিল বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। এঁদের আবেদন ও মন্তব্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হোক, বিতর্ক চলুক, সমালোচকের দল চ্যানেলে চ্যানেলে থাপ্পড়ে টেবিল ভেঙে দিক। তবু, এত কিছুর পরেও তাঁদের বক্তব্যের মৌলিক প্রশ্ন ও ভাবনার গভীরতাকে এড়ানো যায় কী? অথচ সত্য হল, যুদ্ধ কখনও শান্তির বার্তা নিয়ে আসে না। যুদ্ধ সবসময়ই ধ্বংসাত্মক। তাই, পুলওয়ামায় সদ্য ঘটে যাওয়া জঙ্গিহানায় গোটা দেশ যখন ‘বদলা নেওয়া’র আবেগে ভাসছে, তখন কোথায় যেন একটা শুভবুদ্ধির জাগরণের দরকার হয়ে পড়েছিল। অথচ দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেটা বলতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত, তাঁদেরকেই বলতে হল, যাঁদের চোখের জল এখনও শুকোয়নি, যাঁদের সদ্য পিতৃহারা ছোট্ট মেয়েটি এখনও বাবার আদরের অপেক্ষায় দরজার পাশে বসে থাকে। তারপর কখন অন্য মনে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে বাবা এসে এক গালে চুমু দিয়ে যায়।
মিতা সাঁতরা ‘গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকারে’র কথা বলেছেন। সংগত চিন্তাধারা—অথচ তাঁকে কতই না হেনস্তা করলাম। জীবনমরণের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে সদ্য স্বামীহারা যন্ত্রণাকাতর মিতা যখন ‘যুদ্ধে’র বদলে ‘শান্তি’র বার্তা দিচ্ছেন, তখন তাঁকে কত ভাবেই না অপমানিত করা হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল করা হল। শ্মশানের উত্তাপ আর স্বামীর জ্বলন্ত চিতার একরাশ কালো ধোঁয়া যখন তাঁর মনকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল, তখন তাঁর পাশে না থেকে, তাঁর বেদনার সমব্যথী না হয়ে, আমরা তাঁকে আঘাত করলাম, তাঁর শরীরে নয় মনে হৃদয়ে। আর তিনি যে, ‘গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকারে’র কথা বলেছেন, আজকের এই চরম জাতীয়তাবাদের সুসময়ে ‘গণতন্ত্র’ আর ‘বাক স্বাধীনতা’ নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় কোথায়। অথচ, গণতন্ত্রে ‘বাক্্ স্বাধীনতা হচ্ছে স্বতন্ত্র্য ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের; নির্ভয়ে, বিনা প্রহরতায় বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা, অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মত স্বাধীন ভাবে প্রকাশ করার সমর্থিত মূলনীতি’। আইসিসিপিয়ার মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বলা হয়েছে "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোন বাধা ব্যতীত অটল থাকা, পুরো বিশ্বের যে কোনও মাধ্যম থেকে যে কোনও তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনও মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার।’’ কিছু ক্ষেত্রে এর সীমাবদ্ধতা থাকলেও মত প্রকাশ ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিকে তো আর উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু, আমরা জাতীয়তাবাদের নৌকায় পাল তুলে দিয়ে মিতার বক্তব্যের মূল নির্যাসটুকুও নিতে পারলাম না। কিন্তু, সে প্রসঙ্গ আজ থাক।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় পৌনে দু’কোটি মানুষের এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। দুটি দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ । দুটি দেশই সামরিক ও প্রতিরক্ষায় বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে চার বার। আর পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হবার পর হয়েছে এক বার, ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ। যুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোনও লাভ হয়নি, কারন যুদ্ধে লাভ হয়না। অবশ্য দুই দেশেই কিছু স্বার্থান্বেষী কায়েমি গোষ্ঠী আছেন, যাদের যুদ্ধ দরকার , দরকার রাজনীতির অঙ্গনকে গরম রাখার জন্য ।অথচ, দুই দেশেই দারিদ্রতা আর অপুষ্টি স্বাধীনতালগ্ন থেকেই লেগে আছে। রাস্তার পাসে আজও না খেতে পাওয়া মানুষের ভিড়, ফুটপাতে গৃহহীন, পরিচয়হীন তেলচিটচিটে মানুষের নিঃসঙ্গ সহবাস। মাসে মাসে শত শত কৃষক আত্মহত্যার সংবাদ। ফলে দুই দেশেরই আর্থিক সমস্যা বেশি। যুদ্ধ কখনও সমাধান নয়। যুদ্ধ কখনও সমাধান এনে দিতে পারে না। তাই আবারও সেই মিতা, বিজেতার কথা তাঁদের আবেদনের সঙ্গে আজ দুই দেশের মানুষের একসঙ্গে বলার সময় এসেছে, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই’।