Advertisement
E-Paper

যে জন আছে মাঝখানে

আমি মনে করি এবং আমার মতো অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করেন, সহিষ্ণুতা আমাদের দেশের এমন এক পরিচয় যা সহজে যাওয়ার নয়। ইতিহাস বার বার দেখিয়েছে, সেই চরম বামপন্থী শ্রেণিসংগ্রামের গল্প থেকে শুরু করে, যে ধর্ম, বিশ্বাস— এ সব আসলে মনুষ্যত্বের আসল ভিত্তি নয়।

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৭ ১৩:১০
ঐতিহ্য: শারদোৎসবের প্রস্তুতিতে যেখানে ধর্মের কোনও ভেদ নেই। সুন্দরবন, ২০১৬। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ঐতিহ্য: শারদোৎসবের প্রস্তুতিতে যেখানে ধর্মের কোনও ভেদ নেই। সুন্দরবন, ২০১৬। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

মাঝে মাঝে ভাবতে বসি ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আমার অবস্থান ঠিক কোথায়! বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থতিতে, যখন জাতীয় স্তরে গরু-সম্পর্কিত এবং আরও অনেক বিতর্কিত বিষয় প্রতিনিয়ত মাথা চাড়া দিচ্ছে। অনেক বিশিষ্ট মানুষজন কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে, মানবিক অধিকার উপেক্ষা করার বিষয়ে এবং আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। এ সবই বোঝা গেল, কিন্তু আমাদের মতো হিন্দুদের সমস্যাটা একটু অন্য রকম।

আমার মতো এক জন, যে ভগবান বিশ্বাস করে এবং ভয়ও পায়, সব রকমের কাবাব খেতে ভালবাসে, ঠাকুর রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’-এর আদর্শে নাড়া বেঁধেছে, প্রচুর মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে শৈশব কাটিয়েছে, ‘নিজে শান্তিতে বাঁচো অন্যকেও বাঁচতে দাও’ এটাই মানবিকতার শ্রেষ্ঠ পথ বলে ভাবে, মার্কিন মুলুকে আইনকে ধর্মের চেয়ে এগিয়ে রাখার নীতিকে কুর্নিশ করে, মন থেকে অনুভব করে যে বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব বা মহম্মদ রফির গলাটা আসলে ঈশ্বরেরই কণ্ঠস্বর, কাশীতে বাবা বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণার পদতলে তার অগাধ ভক্তি, জীবনের এক নিদারুণ বিপদের মুহূর্তে যে অজমেঢ় শরিফ দরগায় ভক্তিভরে সুতো বাঁধে, যার নির্ভেজাল নিরামিশাষী বৈষ্ণব ঠাকুরদা তাঁর হজ যাত্রা ফেরত বন্ধুর দেওয়া জপের মালা সযত্নে রেখে দিতেন— তেমন এক হিন্দুর এই অবস্থা সম্পর্কে কী ধারণা। আমার মতো আরও অনেক হিন্দুই কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে ঠিক, বৈপ্লবিক, ‘সব রকম ভগবান ঠেঙান কিন্তু নিজেরটুকু ভয়ানক ভাল বোঝেন’— এমন মানুষদের চেয়ে কয়েক যোজন দূরে থাকতে পছন্দ করেন, কিংবা ললাট রঞ্জিত, তরবারি হস্তে নৃত্যরত, গরু-অন্ত-প্রাণ এমন মানুষজনের ধারে কাছে যেতে ভয় পান। আমার মতোই এঁদের অবস্থান কোথায়? এবং এই কথাটি কিন্তু সব ধর্মের মানুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমার মতে এ দেশে হিন্দু কেন, সব ধর্মেই ‘যে জন আছে মাঝখানে’— তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

আমি মনে করি এবং আমার মতো অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করেন, সহিষ্ণুতা আমাদের দেশের এমন এক পরিচয় যা সহজে যাওয়ার নয়। ইতিহাস বার বার দেখিয়েছে, সেই চরম বামপন্থী শ্রেণিসংগ্রামের গল্প থেকে শুরু করে, যে ধর্ম, বিশ্বাস— এ সব আসলে মনুষ্যত্বের আসল ভিত্তি নয়। এই সবই হল মতামতের হাতুড়ি পেটা বৌদ্ধিক তাণ্ডব। ধর্মের জাতপাতের কলঙ্ককে পিছনে ফেলে, ছুঁত-অচ্ছুতের রমরমা পেরিয়ে, বারে বারে মন্দির লুণ্ঠন হওয়ার ঘটনাকে মূলধন করে হিংসা উসকে দেওয়া পরিস্থিতি— এ সব কিছুর মোকাবিলা করে দেশটা সেই জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আমরা একসঙ্গে থাকতে শিখে গিয়েছি। সহিষ্ণুতা আমাদের অন্তরে। এই কথাটা যদি এ দেশটার মানুষ না জানত তা হলে কবে দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে যেত।

হিন্দু ধর্মের ব্যবহারিক দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদী ধর্মে মানুষ যোগদান করেছেন। আবার তাঁরাই নানান ‘হিন্দু’ উৎসবে প্রাণভরে যোগদান করেন। ঠিক তেমনই, বিভিন্ন সময়ে এ দেশে নতুন নতুন আধ্যাত্মিক মানুষ এসেছেন। সমাজের ওপর তাঁদের সার্বিক প্রভাব এবং তাঁদের প্রতি ওই ‘মাঝখানের মানুষ’দের অগাধ বিশ্বাসের ফলে নাস্তিক বুদ্ধিজীবী, গরু-প্রিয় ধর্মগুরু, আর ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ গোছের স্লোগান দেওয়া মানুষজন মাথা তুলতে পারেননি। উদার আধ্যাত্মিকতাই আমাদের সহাবস্থানের পাঠ পড়িয়েছে, রাজনীতি বা বুদ্ধিজীবীরা নয়। ভারতবর্ষের সহিষ্ণুতা সবাইকে জায়গা করে দেওয়া। আজ এক দল লোক সহিষ্ণুতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যদি ভাবে ভারতবর্ষকে পালটে দেবে, তা হতে পারে না।

আবার অন্য দিকে গেল গেল রব নিয়েও আমার আপত্তি আছে। সব ধরনের মেকি রাজনৈতিক ঔদার্যের আড়ালে দুর্নীতি এবং ভণ্ডামির কারণে যে রাজনৈতিক শক্তি হঠাৎ করে দেশে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল, তার উত্থানের জন্য দায়ী কারা? ভোটের রাজনীতির হিসেব দেখলে দেখা যাবে যে, ভোট তো এঁদের সবাই দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন? কোথায় গেল সেই ধর্মনিরপেক্ষতার জীবনদর্শন? সাচার কমিটির রিপোর্টের পর নানা উদারপন্থী লেখায়, কার্যকলাপে, সরকারের অনুসৃত নীতি আর জীবনদর্শনে বার বার আমরা দেখেছি তোষণের রাজনীতির প্রাধান্য, সঙ্গে সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রতি অবহেলা। বরং, উন্নয়নের পরিবর্তে তৈরি হয়েছে অপরাধচক্র, আর বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর মৌরসিপাট্টা। তার পাশাপাশি কেন্দ্রের দুর্নীতি এবং প্রশাসনের অভাবনীয় ব্যর্থতা পরিস্থিতি সঙ্গিন করে তুলেছে। গেল গেল রব তখনই কি তোলা উচিত ছিল না?

ভারতের একটা বিশাল অংশের মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করেন, তা যে ধর্মই হোক না কেন। এই বিশাল অংশ বিশ্বাস করেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে। এঁরাই মূলধারার প্রতীক। ‘ভগবান খেদাও’ বলে যে রাজনীতি আর যে বুদ্ধি-বিচার এঁদের সবাইকে দূরে সরিয়ে দিল, তাদের দাপটের ফলেই আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা জাঁকিয়ে বসেছে। স্বাধীনতার পরে উদার নীতির কথা কংগ্রেস, কমিউনিস্টরা বার বার বলে এসেছে। আজ কী কারণে দুটো দলেরই এই অবস্থা? তা হলে মানুষ নিশ্চয়ই অন্য রকম ভেবেছেন। এক কথায় বলতে গেলে রোগ-মুক্তির জন্য অন্য ট্যাবলেট খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জনগণ। অ্যান্টিবায়োটিকের মতো নতুন ওষুধেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত হিন্দুত্ব ওই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ভারতের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের শিক্ষা ধূলিসাৎ করা চাট্টিখানি কথা নয়। সরকারের কাজ অদ্যাবধি দুন্দুভি সহকারে ঘোষণা ও আড়ম্বর নির্ভর, ওই কর্মফলই বলবে তাঁরা আবার সুযোগ পাবেন কি না।

আমরা যদি বিশ্বাস করে থাকি আমাদের দেশে যে গণতান্ত্রিক প্রথা চালু আছে তাতেই আমাদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত, এটাই আমাদের সিস্টেম, এতেই আমাদের ভরসা, তা হলে আমরা যেন মেনে নিই যে, মানুষই ঠিক করে দেবে কতটা সহনীয় আর কতটা নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সেটা নির্ধারিত হবে। আমরা যদি এত দিনেও মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে বোঝাতে না পারি যে ধর্মের নামে জুলুমবাজি দিয়ে কিছু হয় না, তা হলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা। যখন-তখন আমরা গণমাধ্যমে আমাদের বক্তব্য উজাড় করে দিতে পারি, তাড়া তাড়া লিখতে পারি যে— ভারতীয় হিসেবে কতটা সহ্য করা উচিত আর কতটা নয়, যা খুশি বিতর্ক করতে পারি সহ্যশক্তির কাম্য অনুপাত প্রসঙ্গে। কিন্তু মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে, ভণ্ডামির অভিজ্ঞতা বাজিয়ে দেখবে। সব শেষে নতুন ওষুধের আসল গুণ কতটা আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বা কতটা, তা-ও মেপে নেবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যদি ওষুধের উপকারিতাকে ছাপিয়ে যায়, মানুষ ওষুধ পালটাবেই।

এখনকার পরিস্থিতি দেখে এবং খবর পড়ে মনে হয়, অতীতে আমরা অনেক বেশি সহিষ্ণু ছিলাম, হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি। এই ধারণাটাই ভুল। সাধারণ মানুষ কোনও দিনই সংঘাতে জড়াননি, আজকেও জড়াচ্ছেন না। ঘটনা হল, কোনও দিনই কোনও একটি চরমপন্থী বিশ্বাস বিশালসংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করে একটি ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারেনি— তা বামপন্থীদের শ্রেণিসংগ্রামই হোক কিংবা উগ্রবাদী হিন্দুত্বই হোক। বেশির ভাগ মানুষই চরমপন্থী নন, তাঁরা মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করেন। আসল ভারত মাঝখানেই আছে, এবং থাকবে।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

Tolerance Communal harmony India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy