Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সুকৌশলে মেরুকরণের রাজনীতি চলছেই

রাজনীতির রুটি নিয়ে তা সাম্প্রদায়িকতার আগুনে সেঁকার কাজ চলছেই। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষালআপনারা কি কালীঘাটের বিমান ভট্টাচার্যকে চেনেন? আজ্ঞে না। আমিও চিনি না। তবে বিমানবাবুর কথা জানলাম সাবা নাকভি-র বই ‘ইন গুড ফেইথ’ পড়ে। সাবা-র রচনা থেকে জানলাম, বিমানবাবু কালীঘাটের এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পূজারী।

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪৯
Share: Save:

আপনারা কি কালীঘাটের বিমান ভট্টাচার্যকে চেনেন? আজ্ঞে না। আমিও চিনি না। তবে বিমানবাবুর কথা জানলাম সাবা নাকভি-র বই ‘ইন গুড ফেইথ’ পড়ে। সাবা-র রচনা থেকে জানলাম, বিমানবাবু কালীঘাটের এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পূজারী। কিন্তু তিনি প্রতি দিন তপসিয়ায় মানিকপুরে এক পীরের মাজারেও যান মাথা ঠেকাতে। বিগত ৪৫ বছর ধরে তিনি কালীঘাটে মায়ের পুজো করার পাশাপাশি ওই পীরের পুজোও করে চলেছেন একই ভক্তিতে?

এটা কি বহুমুখী ধর্মীয় ও মানবিক সত্তা নাকি আসলে অখণ্ড? হঠাৎ বিমানবাবুর কথা কেন মনে পড়ল?

ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি নিয়ে সরকারি তৎপরতা এবং প্রতিপক্ষের সমালোচনায় বার বার ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির বিবিধ প্রকাশ দেখলাম। আফজল গুরু এবং ভাটের ফাঁসির সময় কাশ্মীরি মুসলমান সমাজে তো তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এ বার ইয়াকুব। একে সে কাশ্মীরি নয়, আবার জিহাদিও নয়। তাই কাশ্মীরের নেতারা সরব ছিলেন না। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, মুম্বই, হায়দরাবাদের মুসলমান সমাজ তো উত্তেজিত। সমাজবাদী পার্টির এক সাংসদ তো ইয়াকুব মেমনের স্ত্রীকে তাঁর দল থেকে রাজ্যসভার সদস্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আবার বিজেপি-র সাংসদ বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা যখন সরাসরি মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করেন তখনও রাজনীতির রুটি নিয়ে তা সাম্প্রদায়িকতার আগুনে সেঁকার কাজ শুরু হয়ে যায়। দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে বিজেপি-র সাংসদ তাঁকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম আজাদের নামে করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

এই কি আজ ভারতের রাজনীতির অগ্রাধিকার? তা হলে ওই বিমান ভট্টাচার্য যেটা করছেন সেটাই কি অযৌক্তিক, অন্যায়? কিছু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক বলেন, ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসকে অভিজাত বৃত্ত থেকে বের করে আমজনতার সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন গাঁধী। কিন্তু এ কাজটায় তিনি সফল হন এই ‘মাস মবিলাইজেশন’ প্রক্রিয়ায় হিন্দুধর্মের উপাদানকে যুক্ত করেছিলেন বলেই। রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে রামধুনের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় জনসমাজের মধ্যে এক ধরনের হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন। বরং নেহরু এই হিন্দু-জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে এক পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল অনুসরণ করেছিলেন। আর তার সঙ্গে মেশাতে চেয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দর্শন। অনেকে বলেন, গাঁধীর হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার জন্যই জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ধব হয় ‘অ্যান্টি থিসিস’ হিসাবে।

মুসলিম বিচ্ছিন্নতার পিছনে হিন্দু অভিজাত সমাজের শভিনিজম অনেকাংশে দায়ী এ কথা সুবিদিত। সুমিত সরকারের মতো ঐতিহাসিকরাও প্রথম বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস রচনার সময়েও তা বলেছিলেন। আসলে ‘মেজরিটিয়ানিজম’ মানে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন ভিন্ন স্বকীয় জাতি ও ধর্মীয় সত্তাকে না মানা অথবা তার উপর স্টিম রোলার চালানো নয়। ইংল্যান্ডের মতো দেশে যেখানে সংখ্যালঘুদের বৈচিত্র, বিভিন্নতা ও জনসংখ্যা ভারতের তুলনায় খুবই কম, কিছুই নয়, সেখানে ভারতের মতো বহুমুখী বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে সেটা হয় না।

রামমন্দির আন্দোলন আজ অপ্রাসঙ্গিক হলেও সঙ্ঘ পরিবার সন্ত্রাস দমন ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য সামনে রেখে সুকৌশলে দেশের ভিতর মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাইছেন। সঙ্ঘের নেতাদের যুক্তি হল, সন্ত্রাসবাদী মুসলমান হলে তার সন্ত্রাস তার নাশকতামূলক কাজকর্মকে বাম-বিদ্রোহ আখ্যা দিয়ে বুদ্ধিজীবী মর্যাদা প্রমাণ করা যায় না। ফেসবুকে কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, কমরেড ইয়াকুব মেমন অমর রহে।

এই দুটোই কিন্তু চরম মনোভাব। মুদ্রার দু’টি পিঠ। কোনটি আগে আর কোনটি পরে এ গবেষণা অর্থহীনও বটে। ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বৈদিক সাহিত্যেও ছিল সামাজিক ন্যায়ের বার্তা। সামবেদের ঐকতান ভারতীয় বহুত্ববাদের প্রতীক। এমনকী, ৬০০ থেকে ১৬০০ সিই (কমন এরা)-র সময়কালে উত্তরে হিমালয়ের পর্বতমালা থেকে দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত কেরল এলাকা পর্যন্ত ভক্তি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন স্ট্রাটন হাউলে ভারতের ভক্তি আন্দোলনের উৎস সন্ধান নিয়ে বিপুল গবেষণা করে ‘আ স্টর্ম অব সংস— ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য আইডিয়া অব দ্য ভক্তি মুভমেন্ট’ শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। এই বইতেও দেখানো হয়েছে, ভারতে এই ধর্মীয় সমন্বয়ের বিপুল ঐতিহ্য ছিল। দারাশুকোর বেদচর্চা, উপনিষদের অনুবাদকার্য, এ সব যেমন মুগ্ধ করে, আজও ঠিক সে ভাবে সম্রাট অশোক থেকে আকবর— ভারতের এক বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের ঐতিহ্য আমাদের গর্ব করে। তা হলে আজ আবার কেন রাজ্যে রাজ্যে মেরুকরণের রাজনীতি? বহু রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ক্রমবর্ধমান। এমন কথা কখনওই বলা যায় না, গুজরাতে গোধরাই ভারতের প্রথম দাঙ্গা। কংগ্রেস রাজত্বে গুজরাতে অতীতেও দাঙ্গা ছিল খুব বেশি। কলকাতা শহরেও কম দাঙ্গা হয়নি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকে বলেন, ব্রিটিশ ভেদনীতির জন্যই ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসার জন্ম হয়। কিন্তু বাস্তব কারণ হল, প্রাক-ব্রিটিশ যুগেও সম্প্রীতি ও মানবিক ঐকতানের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ফাটলও ছিল। ব্রিটিশ বিভেদ নীতি এই ফাটল বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। আজও সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE