Advertisement
E-Paper

তালাক ও মেয়েদের অধিকার

তিন দশক আগের ঘটনা। শাহবানুকে তাঁর স্বামী বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন। শাহবানু খোরপোশ দাবি করলে স্বামী তালাক দেন। কারণ তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী তিন মাস (ইদ্দতকালীন) খোরপোশ পাবে।

আফরোজা খাতুন

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১০

তাৎক্ষণিক তিন তালাক শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই অধ্যাদেশ আনল সরকার। তার প্রেক্ষিতে রাজ্যের এক মন্ত্রী বললেন, তালাক ছিল, তালাক আছে, তালাক থাকবে। তালাক মানে বিবাহ-বিচ্ছেদ। কেউ বিবাহ-বিচ্ছেদ বন্ধের দাবি জানাচ্ছে বলে শুনিনি। দেশ জুড়ে অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা তালাকের প্রচলিত পদ্ধতির বিরোধিতা করছেন। যে তালাক শাহবানুকে সংসার থেকে নিমেষে বার করে দিতে পেরেছিল, সায়রা বানো, আফরিন রেহমান, আতিয়া সাবরি, গুলশান পারভিন, ইশরাত জাহান এবং আরও অনেক মেয়ের দাম্পত্য সম্পর্কে অধিকারহীনতার কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল, সেই তালাকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে। চলছে মৌখিক তালাক, বহুবিবাহ, হালালা বিয়ে বন্ধের দাবি। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে মুসলিম মেয়ে ও ছেলেদের সমান অধিকারের দাবি। কিন্তু রাজনীতি আর মৌলবাদ মুসলিম মেয়েদের অধিকারের দাবিকে কৌশলে পিষে মারছে।

তিন দশক আগের ঘটনা। শাহবানুকে তাঁর স্বামী বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন। শাহবানু খোরপোশ দাবি করলে স্বামী তালাক দেন। কারণ তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী তিন মাস (ইদ্দতকালীন) খোরপোশ পাবে। তার পর স্বামীর কোনও দায়িত্ব নেই। শাহবানুর খোরপোশের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, মুসলিম মেয়েদের তালাক দিলে খোরপোশ দিতে হবে। সে দিন এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছিলেন বহু মানুষ। তবু এই রায় কার্যকর হয়নি। মুসলিম মৌলবাদের চাপে, নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রাজীব সরকার পার্লামেন্টে বিল পাশ করে দিল। তালাক দিলেও মুসলিম মেয়েদের খোরপোশ দিতে হবে না। সুপ্রিম কোর্টে জিতেও সে দিন অধিকার পায়নি মুসলিম মেয়েরা।

তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে পাঁচ মহিলার আবেদনের ভিত্তিতে গত বছর অগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ। এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে মুক্তমনা মানুষরা

যখন আলোর দিশা খুঁজছেন তখন আবার এল ধাক্কা। বৈষম্যপূর্ণ তালাক বিল পাশ হল লোকসভায়। বিরোধীরা রাজ্যসভায় আটকে দিল। তাই সামান্য সংশোধন-সহ তড়িঘড়ি অধ্যাদেশ আনল মোদী সরকার।

তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ। তা হলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিয়ে গৃহ থেকে বার করলে তা গার্হস্থ্য হিংসা আইনে পড়ার কথা। সেই গার্হস্থ্য হিংসা আইন তো ভারতে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে মান্যতা দিয়ে গার্হস্থ্য হিংসা আইনের মধ্যেই সেই অপরাধকে জুড়ে দেওয়া যায় না কি? কেন্দ্রের অধ্যাদেশে মুসলিম মেয়েদের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। স্ত্রী বা তাঁর আত্মীয়রা তাৎক্ষণিক তিন তালাকের অভিযোগ করলে স্বামী জেলে যাবে। সন্তান থাকবে মায়ের কাছে। খোরপোশ দেবে স্বামী। ম্যাজিস্ট্রেট খোরপোশ নির্ধারণ করবেন। জেলবন্দি স্বামী খোরপোশ দিতে না পারলে সন্তান-সহ মহিলার আর্থিক নিরাপত্তা কে দেবে? প্রশ্ন তুললে বিজেপির এক কর্মী সাংবাদিকদের বললেন, সে ক্ষেত্রে আত্মীয়েরা দেবে। শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নস্যাৎ করার সময়ও ঠিক এই বয়ান তৈরি হয়। তালাক পাওয়া মেয়েদের স্বামী তিন মাস খোরপোশ দেবে। তার পর দায়িত্ব আত্মীয় বা ওয়াকফ বোর্ডের। কী বিচিত্র মিল! খোরপোশ দেবে আত্মীয়রা? সে দিনও সামনে নির্বাচন ছিল। আজও নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে। বদলে গিয়েছে শুধু শাসক দলের মুখ।

অধ্যাদেশ বলছে, তাৎক্ষণিক তালাকে অভিযুক্ত তিন বছর জেল খেটে (অথবা স্ত্রী তাঁর মুক্তির আবেদন করলে) ছাড়া পেতে পারেন। তার পর? যদি স্ত্রীর কাছে স্বামী ফিরতে চায়, তা হলে হালালা বিয়ের ফতোয়া আসবে। তাকে আটকানোর আইন কোথায়? অথবা স্বামী জেল খাটল, খোরপোশও দিল, কিন্তু আবার একটি বিয়ে করল। পূর্বের স্ত্রীকে নিল না। সেখানে কি তালাক হয়েছে ধরা হবে? ‘তালাক হয়েছে’ বললে সুপ্রিম কোর্টের রায় টিকল না, তাৎক্ষণিক তালাক বৈধতা পেল। আবার ‘তালাক হয়নি’ বললে স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না।

মুসলিম মেয়েদেরও তালাক দেওয়ার অধিকার আছে, এ কথা প্রচার করে তুষ্টি লাভ করা যায়। বিয়ের সময় মুসলিম মেয়েরা মুখে সম্মতি এবং কাবিলনামায় সই দিলে তবে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। বিচ্ছেদের জন্য সেই নিয়ম করা যেতে পারত না কি? যাঁরা বলছেন ‘তালাক ছিল, তালাক থাকবে’ তাঁদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। তবে তালাক বা বিচ্ছেদ হতে হবে সাংবিধানিক আইন মেনে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অধিকার থাকবে তালাকের জন্য লিখিত আবেদন জানানোর। পুরুষের একপেশে অধিকারে, মেয়েদের সম্মতি ছাড়া বিচ্ছেদ হবে কেন?

বাংলাদেশের এক নাগরিক দুঃখ করছিলেন, সে দেশে তালাকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে বলে। এটা নাকি বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইনের জন্যই হচ্ছে। কারণ স্বামী-স্ত্রী যে কেউ তালাকের জন্য লিখিত আবেদন জানাতে পারে। মেয়েরা আইনের সুবিধা পাওয়াতেই বাংলাদেশে তালাক বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। এটাই পুরুষতন্ত্রের আসল রূপ। মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখা।

ভারতের মুসলিমরা জীবন-জীবিকার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই শরিয়তের বাইরে চলে এসেছে। একমাত্র মেয়েদের অধিকারের জায়গায় শরিয়তের শুদ্ধতা নিয়ে বার বার আস্ফালন। নারী-পুরুষ সমান অধিকার চাইলে, সব সম্প্রদায়ে মৌলবাদের একই চরিত্র প্রকাশ হয়। এ দেশে হিন্দু কোড বিল পাশ হওয়ার সময়ও রক্ষণশীল হিন্দুরা প্রবল বিরোধিতা করেছিল। তাঁদের অন্যতম ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এখনও স্বপ্নের ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হিন্দু মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুরের সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনে, মেয়েদের বশ্যতা দাবি করছে। এ ব্যাপারে লিফলেট বিলি হয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে।

আজ হিন্দুত্ববাদী দলের সরকার তড়িঘড়ি অধ্যাদেশ জারি করে মুসলিম মেয়েদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত করছে। সেখানে মেয়েদের অধিকারও স্পষ্ট নয়, তাদের আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্নেও ধোঁয়াশা। খোরপোশের নিরাপত্তা না থাকলে মা সন্তানদের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে না। সন্তানের লেখাপড়াও বন্ধ হতে পারে। তাই মুসলিম পুরুষদের জেলবন্দি করার আগ্রহ ছেড়ে, সরকার

সুনিশ্চিত করুক তাৎক্ষণিক তিন তালাকের অবৈধতা। মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম-অধিকারের ভিত্তিতে তৈরি হোক তালাকের (বিবাহ-বিচ্ছেদের) সাংবিধানিক আইন।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন-এ বাংলার শিক্ষক

Triple talaq Women Rights
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy