Advertisement
E-Paper

নূতন আফিম

শেষ অবধি গ্রহণ কাটিয়াছে। বাঙালির বিনোদনে পূর্ণগ্রাস চলিতেছিল। কলাকুশলী ও প্রযোজকদের দ্বন্দ্বে সিরিয়াল বন্ধ, বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। গৃহস্থের মুখ পাংশু, হৃদয় অবসন্ন, কড়িকাঠ হইতে কালান্তক বাদুড়ের ন্যায় বিষাদ ঝুলন্ত।

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
অবশেষে: শুরু হল বাংলা সিরিয়ালের শুটিং। শুক্রবার ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয়। ছবি: রণজিৎ নন্দী

অবশেষে: শুরু হল বাংলা সিরিয়ালের শুটিং। শুক্রবার ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয়। ছবি: রণজিৎ নন্দী

শেষ অবধি গ্রহণ কাটিয়াছে। বাঙালির বিনোদনে পূর্ণগ্রাস চলিতেছিল। কলাকুশলী ও প্রযোজকদের দ্বন্দ্বে সিরিয়াল বন্ধ, বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। গৃহস্থের মুখ পাংশু, হৃদয় অবসন্ন, কড়িকাঠ হইতে কালান্তক বাদুড়ের ন্যায় বিষাদ ঝুলন্ত। সমগ্র সন্ধ্যা মলিন হইয়া যাইল, পরিবারের কে কী করিবে ভাবিয়া না পাইয়া এমনকি মাঝে মাঝে বাক্যালাপও করিতে লাগিল। বহু কাল পরে সান্ধ্য পশ্চিমবঙ্গ শুনিতে পাইল স্বামী ও স্ত্রীর কথোপকথন, মাতা ও সন্তানের কুশলজিজ্ঞাসা। কিন্তু তাহা কতিপয় মুহূর্ত স্থায়ী, তাহার পরেই এই অনভ্যস্ত ব্যায়াম অশেষ বিরক্তিতে গড়াইয়া, বিবাদ ও বিপন্ন চিৎকার সৃষ্ট হইল। সমাজতাত্ত্বিকরা ভাবিতে বসিলেন, মানুষ আত্মীয়ের সঙ্গ সহ্য করিতে পারে না বলিয়া সিরিয়াল আবিষ্কার করিয়াছে, না সিরিয়াল আবিষ্কার করিয়াছে বলিয়া আত্মীয়তা স্খলিত হইতেছে। কিন্তু ইহার অপেক্ষা গুরুতর চিন্তা: টিভি আবিষ্কারের পূর্বে আদিম যে মানুষেরা ঘুরিত-ফিরিত, তাহারা সন্ধ্যা যাপন করিত কী করিয়া। সন্ধ্যাকালে (যদি বিকাল পাঁচটা হইতে রাত্রি এগারোটাকে ‘সন্ধ্যা’ অভিহিত করা যায়) সিরিয়াল দেখা ও সমগ্র সকাল সেই সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষমাণ থাকা— ইহাই তো মানুষের আনন্দ-উৎস, ইহা কাড়িয়া লইলে জীবনের কেন্দ্রটিই চ্যুত হইয়া যায়। সিরিয়াল বিনোদন নহে, বহু মানুষের নিকট জীবনের আবশ্যিক অঙ্গ। যেমন গ্যাস ফুরাইয়া যাইলে বা বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হইলে মানুষ আতান্তরে পড়ে, তেমনই সন্ধ্যাকালে প্রতিটি সিরিয়ালের প্রাচীন এপিসোডের পুনরাবৃত্তি দেখিতে বাধ্য হইলে এই রাজ্যে ক্রোধ ও অপ্রসন্নতা বাড়িতে বাড়িতে হানাহানি শুরু হইয়া যাইতে পারিত।

সেই জন্যই মুখ্যমন্ত্রী হাত বাড়াইয়া দিলেন। কেহ বলিতেই পারে, স্টুডিয়োপাড়ায় প্রযোজক ও শিল্পীদের মধ্যে মনকষাকষি লইয়া স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আদৌ ব্যস্ত হইবেন কেন। কিন্তু ইহা এক সামাজিক সমস্যা, এবং সমাজের সিংহভাগের সমস্যা। একটি রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ বিষাদবিমূঢ় হইয়া পড়িলে তো সেই রাজ্যের কর্মক্ষমতা ও মেরুদণ্ড সকলই নুইয়া পড়িবে। যদিও তিনি কমিটি গড়িয়া দিয়া এবং তাহাতে বিবদমান গোষ্ঠীর কিছু প্রধান সদস্য রাখিয়া ‘আপসে সকল মিটাইয়া লও’ গোত্রের যে বার্তা দিয়াছেন, তাহার ঘোষণা যত সহজ, বাস্তবায়ন তত সহজ নহে, কারণ কমিটির সভায় ঐকমত্য ঘটিবে কে বলিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের নজর অন্যত্র। তাহারা জানিতে পারিয়াছে, সিরিয়াল-শিল্পীরা প্রত্যহ ১২-১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন, পারিশ্রমিক পাইবার ক্ষেত্রেও প্রবল বিলম্ব সহ্য করিতে বাধ্য হন। অথচ গৃহস্থের ধারণা ছিল, সিরিয়ালের অভিনেতৃগণ অলৌকিক আরামে থাকেন, গাড়ি হাঁকাইয়া আসেন ও বিরিয়ানি ভক্ষণ করিয়া, স্বল্প সংলাপ ও নেত্রপাত অন্তে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লইয়া গজগমনে বিলাসভবনে প্রত্যাবর্তন করেন। এখন তো তাঁহাদের নিতান্ত শ্রমিক মনে হইতেছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অধিক বঞ্চিত! ইহা বুঝিয়া সামান্য ধর্ষকামী পুলক জাগিয়াছে, সহানুভূতিরও বান ডাকিয়াছে। ইহাও সিরিয়ালের ন্যায় নাটকীয়।

কিন্তু এই ঘনঘটার মধ্য দিয়া কয়েকটি সত্য বাহির হইয়া আসে— এক, যে নারীরা গৃহে থাকিয়া কাজ করেন, তাঁহাদের কাজের ভার হয়তো কিছু কমিয়াছে। নহিলে দিনের পর দিন এতগুলি করিয়া ঘণ্টা শিল্প দেখিয়া কাটাইয়া দেওয়া যাইত না। ইহার কারণ হিসাবে প্রযুক্তির উন্নতি, বা নারীর নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, বা পুরুষেরও পুংতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির শিথিলতা, বা এই সকলের শুভমিশ্রণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় কি না, পণ্ডিতেরা বলিবেন। দুই, শিল্পের এমন দিন আর আসে নাই, যখন প্রতিটি মানুষ দিনের অধিকাংশ সময়ই শিল্পভোগ করিয়া কাটাইতেছেন। যাঁহারা ‘সিরিয়াল’ শুনিলে নাসিকা কুঞ্চিত করেন, তাঁহারা ওয়েব সিরিজ় দেখেন, যাঁহারা টিভি শুনিলে স্মিতহাস্যে মুখ ফিরাইয়া লন, তাঁহারা মোবাইলে চক্ষু সাঁটিয়া দিন কাটাইয়া দেন। তিন, এক দিন শুটিং বন্ধ হওয়ামাত্র ‘রিপিট টেলিকাস্ট’ শুরু করিতে হইল, ইহার অর্থ একটি দিনেরও ‘ব্যাঙ্কিং’ বা অগ্রিম কাজ করিয়া রাখা হয় না। প্রায় কোনও প্রযোজক সংস্থাই সেই অভ্যাস করে নাই। ইহাতে প্রমাণিত হয়, সংবৎসর পড়া না করিয়া, পরীক্ষার পূর্বে প্রাণপণ পড়িয়া, স্টেজে মারিয়া দিবার সংস্কৃতি বাঙালির সমান জারি রহিয়াছে। যদিও স্টেজ না বলিয়া ফ্লোর বলিলে, আক্ষরিক সামীপ্য ঘটিত!

যৎকিঞ্চিৎ

কালাশনিকভ এক রাশিয়ান সংস্থা, একে-৪৭ বন্দুক তৈরি করে বিশ্বখ্যাত। এ বার তারা তৈরি করেছে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, দেখতে অনেকটা প্রাচীন গাড়ির মতো, আর একটা রোবট, যেটা বিশাল, জগদ্দল এবং এক্কেবারে নড়ছেই না। রোবটটাকে নিয়ে তো বিদ্রুপ আর ‘মিম’-এর ঝড় চলেছে। কিন্তু হঠাৎ এ সব তৈরির কারণ কী, বন্দুকের চাহিদার কি আকাল পড়ল? তবে কি পৃথিবী হচ্ছে ক্রমশ অহিংস্র? না কি লোকে এ বার শত্তুরকে গাড়িচাপা দেবে ও রোবট লেলিয়ে দেবে!

Bengali Serial Strike Tele Industry টিভি সিরিয়াল Tollygunge
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy